নারায়ণগঞ্জর সাবেক দুইজন এমপিকে নিয়ে বিএনপির ভেতরে নতুন করে তুলকালাম ঘটছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চাঞ্চল্য। বিপরীতে এ দুটি আসনে সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আছে অস্থিরতা। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এ দুইজন বেশ জনপ্রিয় নিজ নিজ সংসদীয় আসনে। দেশের এ সঙ্কটে অভিজ্ঞতাতেও দুইজন অপ্রতিদ্বন্দ্বি।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জালালউদ্দিন। আশির দশকের মাঝামাঝিতে স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অত্র আসন থেকে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সদস্য নাসিম ওসমান। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপি দলীয় প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামীলীগ দলীয় প্রার্থী এস এম আকরাম। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমান। ওই নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে নাসিম ওসমান পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৭ ভোট। অপরদিকে বিএনপির অ্যাডভোকেট আবুল কালাম ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছিলেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৩৬ ভোট। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অত্র আসন থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন জাতীয় শ্রমিকলীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ। তবে মহাজোটের স্বার্থে অত্র আসনটিকে ছাড় দেয় আওয়ামীলীগ। যেকারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন মহাজোটের প্রার্থী নাসিম ওসমান। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল নাসিম ওসমান ইন্তেকাল করলে ২৬ জুন অনুষ্ঠিত উপ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান প্রয়াত নাসিম ওসমানের ছোট ভাই বিকেএমইএ’র সভাপতি সেলিম ওসমান। ওই উপ নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামীলীগ দলীয় সাবেক এমপি এস এম আকরাম নির্বাচন করলেও মহাজোট ইস্যুতে আওয়ামীলীগ কোন প্রার্থী দেয়নি। ওই নির্বাচনে সেলিম ওসমান পেয়েছিলেন ৮২ হাজার ৮৫৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম আকরাম পেয়েছিলেন ৬৬ হাজার ১১৪ ভোট। ২০১৮ ও সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে সেলিম ওসমান এমপি হন।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি ও মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কালাম বলেছেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান জনকল্যানমুখী করার একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন। যোগ্যতা, স্বচ্ছতা, আত্মত্যাগ ও সততার জন্য আগামী নির্বাচনে বিএনপি তাকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে আবারো মনোনয়ন দেবেন বলে আশাবাদী তিনি।
জনগণকে তাঁর প্রতি অতীতের মতো আস্থা রাখান আহবান করে সাবেক এমপি আবুল কালাম বলেন, নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। বিএনপি সব সময় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। সেই হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা অবশ্যই কাম্য। পাশাপাশি যারা মনোনয়ন প্রার্থী হবেন তাদের এটা নৈতিক অধিকার এবং দলের থেকেও তদের একটা অধিকার বর্তায় নিজের আত্মপ্রকাশ করার। এটা সকলেরই থাকবে। আমাদের দলে যারা নেতৃত্বে রয়েছেন ওনারা সু-বিবেচনায় নিবেন। অতীত আর বর্তমান সবটাই মূল্যায়ন হবে। মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে আমি আত্মবিশ্বাসী। কারণ এর আগে যতবার নির্বাচন আসছে ততবার আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আমি আশাকরি ইনশাল্লাহ আগামী দিনে আমার যোগ্যতা, স্বচ্ছতা, আমার আত্মত্যাগ এবং আমার যে সততার অধ্যায় রয়েছে সে হিসেবে আমি নিজেকে জনগণের সেবা করার উপযুক্ত মনে করি। আমার দলও সেই বিবেচনায় আমাকে মনোনয়ন প্রদান করবেন। আমি আমার জনগণের কাছে একটাই আবেদন রাখবো যে, আপানারা অতীতে আমার উপর আস্থা রেখেছেন। আগামী দিনেও আমার উপর আস্থা রাখবেন সেই বিশ্বাস আমার আছে। আমি আপনাদের সকলের কাছে দোয়া প্রার্থী।
তিনি আরো বলেন, দলের মধ্যে যে কোনো কোন্দল নেই সেটা আমি অবিশ্বাস করিনা। তবে সেটা আমি একটা পর্যায়ে রাখতে চাই। তা হলো পদ পদবীর জন্য নির্বাচনের জন্য নয়। নির্বাচনে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবো। এখানে কোনো শত্রুতা থাকবেনা।
আবুল কালাম আরো বলেন, আমি ছাত্র অবস্থায় থেকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলাম। পরবর্তীতে স্কুল কলেজ জীবনে সক্রিয় রাজনীতিতে আসি। এর আগে আমার পিতা মরহুম হাজী জালালউদ্দিন সাহেব এই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকেই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের সংসদে সংসদ (এমপি) ছিলেন। পারিবারিকভাবেই আমাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপট থেকে ৯১ সনের নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাকে স্নেহধন্য করে মনোনয়ন দান করেছেন। তখন জনগন আমাকে নির্বাচিত করে জনপ্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবেই রয়েছি। আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশবাসী অধীর আগ্রহে আছেন একটি নির্বাচনের জন্য। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন সকলে চায়।
এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। সম্প্রতি এক কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি নিজেই।
২০০১ সালে এই আসন থেকেই আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমানকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন গিয়াস উদ্দিন। বিগত আওয়ামী লীগের সময় কঠিন মুহূর্তে জেলা বিএনপির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এসময় সাহসিকতার সঙ্গে তিনি তাঁর দক্ষ নেতৃত্বের পরিচয় যার কারণে শামীম ওসমানের চক্ষুশূলে পরিণত হতে হয় তাকে। অনবরত সরকার ও সরকারের দলীয় প্রশাসন দ্বারা নির্যাতনের শিকার হতে হলেও নারায়ণগঞ্জ জেলাজুড়ে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হোন।
গিয়াস বলেন, আমরা রাজনীতি করি জনগণের জন্য, দেশের জন্য। দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করবো, এই প্রতিশ্রুতি আপনাদের সামনে দিচ্ছি। আগামী নির্বাচনের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমার নেতাকর্মীদেরও আহবান জানাচ্ছি, প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য। ইনশাল্লাহ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে। বিএনপিকে ভোট দিয়ে আবারও দেশের সেবা করার সুযোগ দিবেন সেই প্রত্যাশাই থাকবে।
গিয়াসের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ১৭ জুন দীর্ঘ ১৪ বছর পর জেলা বিএনপির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। । যে সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হোন গিয়াস উদ্দিন। এই সম্মেলনে লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর আগে জেলা বিএনপির আহবায়ক থাকা অবস্থায় তিনি পুরো জেলা বিএনপিকে ঢেলে সাজান। বিএনপিকে আগের তুলনায় করেন আরও সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী। তার বিভিন্ন কর্মকান্ডে জেলা বিএনপি নতুন করে জেগে উঠে। এর ফলে শামীম ওসমানের প্রধান টার্গেটে পরিণত হোন গিয়াস উদ্দিন। শামীম ওসমানের এমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই যেখানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি গিয়াসের সমালোচনা করেন নি। তাকে নিয়ে শামীম ওসমানের অতিকথনে গিয়াস উদ্দিন বারবার খবরের শিরোনাম হোন। এদিকে ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে জেলাজুড়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্ধ শুরু হলে নেতাকর্মীদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে প্রশংসায় ভেসেছিলেন মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। প্রতিনিয়ত তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে অংশ নিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে নানা দিকনির্দেশামূলক বক্তব্য প্রদান করেন। তার বক্তব্য শুনে বিএনপির নেতাকর্মীরা আগের তুলনায় প্রতিনিয়ত সুসংগঠিত ও শক্তিশালী হয়েছিল। এর আগে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হলে তা শক্ত হাতে দমন করেন তিনি। পাশাপাশি জেলার আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে প্রশাসনকে সব ধরণের সহযোগিতা করেন। সেই সঙ্গে তার নির্দেশনায় ৫ আগস্ট থেকেই জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাহারা দিয়েছিলেন নেতাকর্মীরা। এর আগে জেলা বিএনপির কমিটি হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাবশালী শামীম ওসমানের মাথাব্যাথা হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায় গিয়াস উদ্দিন। কারণ ২০০১ সালে তাকে হারিয়েই মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে একের পর এক কর্মসূচি সফলভাবে পালন করেন গিয়াসের নেতৃত্বাধীন জেলা বিএনপি। জেলা বিএনপির প্রতিটি অঙ্গসংগঠনকে ঢেলে সাজাতে থাকেন তিনি। কিন্তু সাহসী নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তাকে পথে পথে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় দায়ের হয় অসংখ্য মামলা। ২০২৩ সালে ও ২০২৪ সালে বছরব্যাপী নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি নতুন মোড় নিয়েছিল। বছরের পুরোটা সময় গিয়াসের সমালোচনায় মুখর ছিলেন একেএম শামীম ওসমান। জেলা বিএনপির আহবায়ক থাকা অবস্থায় তিনি পুরো জেলা বিএনপিকে ঢেলে সাজান। বিএনপিকে আগের তুলনায় করেন আরও সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী। তার বিভিন্ন কর্মকান্ডে জেলা বিএনপি নতুন করে জেগে উঠে। গত ২৪ ডিসেম্বর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্তি করা হলেও এখনো নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন তিনি। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে রাজপথ সরগরম রেখেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :