এক অসুস্থ রাজনীতির কি নিষ্ঠুর পরিণতি! এমনটাই যেন ঘটেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদের বেলায়। একসময় নারায়ণগঞ্জ সহ সকল জায়গাতেই দাবড়িয়ে বেড়ালেও সময়ের আবর্তে তাকে দেশ ছেড়ে বিদেশে থাকতে হচ্ছে। দেশের মাটিতে অর্থ সম্পদ সবকিছু থাকা সত্বেও দেশে ফিরতে পারছেন না। পরিবার পরিজন ছেড়ে নিজের জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে বিদেশে অবস্থান করতে হচ্ছে। অথচ একসময় এই হাবিবুর রহমানের ভয়ে অনেককে পরিবার পরিজন ছেড়ে বাড়ির বাইরে অবস্থান করতে হয়েছে। এবার সেই রিয়াদই নিজের জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন। এরই মধ্যে তার জন্মদাতা মা দুনিয়া ত্যাগ করেছেন। মায়ের শেষ বিদায়ের সময়ে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়নি হাবিবুর রহমান রিয়াদের। তার উপস্থিতি ছাড়াই ইহ জনমের বিদায় নিয়ে গেলেন। যা একটি সন্তানের জন্য কতটুকু কষ্টের একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন যার বেলা এমনটা হয়ে থাকে।
জানা যায়, শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) ভোররাতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও তোলারাম কলেজের স্বঘোষিত ভিপি হাবিবুর রহমান রিয়াদের মা ইন্তেকাল করেছেন। সেই সাথে তার জানাযা ও কাফন দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তবে এর কোনো আনুষ্ঠানিকতাতেই উপস্থিত থাকতে পারেননি হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ইচ্ছা থাকা সত্বেও নিজের জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে মায়ের বিদায়ের বেলায় তাকে বিদেশেই অবস্থান করতে হয়েছে।
জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে নারায়ণগঞ্জে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করতেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তার ছেলে অয়ন ওসমানও আওয়ামী লীগের কোনো পদ পদবীতে না থেকেও রাজনীতিতে অনেক প্রভাব ফেলতেন। বিশেষ করে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগকে তিনি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের পদে আসতে হলে তার অনুগত হতে হতো। তার আনুগত্যের বাইরে কেউই ছাত্রলীগের পদে আসতে পারতেন না। সেইসঙ্গে অয়ন ওসমানের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতারা অনেক সময় মূলদলের নেতাদেরও অপমান অপদস্থ করতেন। তাদের কারণে ত্যাগী নেতারাও মূল্যায়ন পেতেন না।
পাশাপাশি অয়ন ওসমানের অনুসারী এসকল ছাত্রলীগ নেতারা বিপুল পরিমাণ টাকার মালিকও বনেছেন। শূন্য থেকে দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ছাত্র অবস্থায়ই অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিল তাদের হাতে। সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শামীম ওসমানের অস্ত্রের মহড়ায় তারা অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৮ জুলাই চাষাঢ়ায় প্রথম সংঘর্ষে দুপুর ২টার দিকে অস্ত্র নিয়ে গুলিবর্ষণ ও হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। যেখানে অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন অয়ন ওসমানের অনুসারী রিয়াদ প্রধান। পরবর্তী সময়ে শামীম ওসমানের নেতৃত্বেই আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায় এই বাহিনী। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে তাদের কেউ এখন দেশের বাইরে রয়েছেন কিংবা দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ।
কলেজের ভেতর টর্চার সেল গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তার এসকল কাজের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম রাফেল প্রধান। অয়ন ওসমানের প্রভাব ব্যবহার করে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, ঝুট নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি করে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তারা।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করে একটি শটগানের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। আবেদনে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জালাল এন্টারপ্রইজ’ উল্লেখ করা হয়েছিল। এটি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
২০২৪ সালের ১৫ জুলাই রাতে সরকারি তোলারাম কলেজের সামনের সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছাত্রদলের ৪ নেতাকর্মীকে পেটায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে গেলে ছবি ও ভিডিও ধারণে বাধা দিয়ে দুই সাংবাদিককে মারধর করেন তারা। তাদের মোবাইলফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরকারি তোলারাম কলেজে ফরম পূরণ করতে গিয়ে রিয়াদ ও তার লোকজনের মারধরের শিকার হন ওই কলেজের দুই শিক্ষার্থী আতা-ই-রাব্বি ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। তারা দুজন ওই কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহবায়ক ও যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন।
২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে কলেজের সামনের সড়কে আরেক শিক্ষার্থী শাহজাহান আলীকে পিটিয়েছিলেন রিয়াদের নেতৃত্বে তোলারাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তোলারাম কলেজে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ করার জেরে সাংবাদিকের ওপর দুই বার হামলার অভিযোগও আছে। এ ঘটনায় ডেইলি স্টারের সাংবাদিক সৌরভ হোসেন সিয়াম ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেছিলেন। সেই হাবিবুর রহমান রিয়াদ নিজেই জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে রয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :