নারায়ণগঞ্জে কোন অঘটনে দেখা মিলতো শাহ নিজামকে। তিনি ছিলেন শামীম ওসমানের ডান হাত খ্যাত। বিগত এক দশকে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন ঘটনায় তাকে প্রকাশ্য পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। প্রায়শই কোমরে রাখা পিস্তল প্রদর্শন করতেন তিনি। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারী তিনি প্রকাশ্য গুলি করে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে হত্যার চেষ্টা করেন। এর আগে মিশনপাড়ায় ছাত্রদলের একটি মিছিলেও গুলি করেছিলেন তিনি। ৫ আগস্টের আগেই তিনি দেশ ছাড়েন। চলে যান দুবাইতে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ৫ আগস্টের আগেই জুলাইয়ের শেষের দিকে দেশ ছেড়ে থাইল্যান্ড যান নিজাম। ৫ আগস্টের পর চলে যান দুবাইতে। সেখানকার দেইরা এলাকাতে তিনি ফ্লাট নিয়ে বসবাস করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শাহ নিজাম। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। সায়াম প্লাজা নামের মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি সাবেক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের পরিত্যক্ত কক্ষগুলোকে তিনি এক সময়ে অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেখানে ছিল বিলিয়ার্ড বোর্ড ও টেবিল টেনিস।
৫ আগস্টের আগে নিজামের মালিকানাধীন ‘নম পার্কে’ কথিত র্যাফেল ড্র এর নামে জুয়া, পাগলায় একটি আবাসন প্রকল্পে জোর জবস্তি সহ বেশ কিছু অভিযোগ ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়ে উঠা কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে নিজামের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার চিত্র। ল্যান্ডক্রুজার, মার্সিটিজ বেঞ্চ সহ তিনটি বিলাসবহুল গাড়িতে নিয়মিত চড়তে দেখা গেছে তাকে সহ পরিবারের সদস্যদের যেসব গাড়ির একেকটার দাম বাংলাদেশী টাকায় কোটি টাকার উপরে। এছাড়াও ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে দেখা মিলেছে বিদেশী বাতি সহ অনেক মূল্যবান আসবাবপত্রের। দৃশ্যমান কোন ব্যবসা না থাকলেও পাগলায় একটি আবাসিক প্রকল্প তদারকি সহ বেশ কিছু বড় সড়কের টেন্ডার পেয়েছিলেন নিজাম। এছাড়া নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্কে রাইড না থাকলেও সেখানে সকাল থেকে রাত অবধি পর্যায়ক্রমে দামী গাড়ির বহর দেখা যায় যেগুলোতে চড়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা ইস্যুতে বিচার প্রার্থীরা সেখানে ভিড় করে। এছাড়া পার্কে থাকা জেড এন রেস্টুরেন্টেও নিয়মিত বিভিন্ন এলাকার জমি বিক্রির দালাল চক্রেরও আনাগোনা থাকে নিয়মিত।
গত ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ সরকার পতন হলে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে পালায় ওসমান পরিবারের সকল সদস্য এবং তাদের দোসররা। এর ঠিক পরই জানা যায় প্রভাব বিস্তার করে একাধিক ব্যবসায়ীর জমি দখলের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছিলো নমপার্ক। জানা যায় মোহাম্মদ নেওয়াজ আলী নামে কাতারের এক প্রভাবশালী প্রবাসী ব্যবসায়ীর ৩৪ শতাংশ জমি ছিলো এখানে। তিনি তার স্ত্রীর নামে প্রায় দশ বছর আগে আইএফআইসি ব্যংকের কাছ থেকে জমিটি ক্রয় করেন। কিন্তু এরপরই নেওয়াজ আলী এবং আরো বেশ কয়েক জনের জমিতে নমপার্ক করা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর নেওয়াজ আলী সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় নমপার্কের ভেতরে দীর্ঘদিন দখল হয়ে থাকা তার ৩৪ শতাংশ জমির দখল বুঝে নেন এবং তার স্ত্রীর শামীমা নেওয়াজের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে সেখানে দেয়াল নির্মাণ করেন।
কুতুবপুরের মীর হোসেন মিরু, লামাপাড়ার মোফাজ্জল হোসেন চুন্নু, রফেদ আলী, মিথুন সহ অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী যারা বিগত দিনে মাদক অস্ত্র নিয়ে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। এলাকাতে তাদের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং লালন, দখলবাজী, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তর অভিযোগ থাকলেও নিয়মিত দেখা মিলছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা সমাবেশে। বিপরীতে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে ‘প্রত্যাশা’ নিয়ে মাঠে নামলেও প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান। অভিযোগ আছে উপরোক্ত বিতর্কিত ব্যক্তিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত দেখা মিলে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজামকে।
নারায়ণগঞ্জ প্রবেশমুখ সাইনবোর্ডে রাজত্ব চলে সুরুজ ব্যাপারী ও রাজ্জাক ব্যাপারীর। উৎসব পরিবহনের একটি বাস থামিয়ে ককটেল বিস্ফোরণ করে টাকা ছিনতাই ও হত্যা মামলার পেছনে সুরুজ ব্যাপারীর সম্পৃক্ততা ছিল। ওই ঘটনায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করেছিল। এলাকাবাসী জানায়, সুরুজ বেপারী এক সময় শরীয়তপুরের আলোচিত তনাই মোল্লা বাহিনীর সদস্য ছিল। পরে সে ২০০১/২০০২ সালের দিকে সাইনবোর্ড শান্তিধারা এলাকায় এসে ঘাঁটি ঘাড়ে। এখানে সে গড়ে তোলে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট এলাকায় জমি দখল থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম শুরু করে। এলাকায় কোন জমি ক্রয়-বিক্রয় হয় না এই বাহিনীর নলেজ ছাড়া। এরপর সুরুজ সিন্ডিকেট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ থেকে সাইনবোড ও ঢাকা নারায়ণগঞ্জ-লিংক রোডকে টার্গেট করে একটি ছিনতাইকারী বাহিনী গড়ে তোলে। ওই বাহিনীর প্রধান সে নিজেই। শুরু হয় ভ‚মিদস্যুতার পাশাপাশি তার ছিনতাই কর্মকাণ্ড। দিন দিন এই বাহিনী এলাকায় বেপোরায় হয়ে উঠে। সুরুজের বিরুদ্ধে হত্যা, ছিনতাই, জবরদখলসহ বিভিন্ন ঘটনায় ১১টি মামলা রয়েছে। সম্প্রতি এ সুরুজের অনুষ্ঠানেও দেখা গেছে নিজামকে।
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারী হকার উচ্ছেদ নিয়ে শহরে হকারদের সঙ্গে তখনকার মেয়র আইভী সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেদিন প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তাঁর সমর্থকদের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন নিয়াজুল। সে সময় আইভী নিয়াজুল সহ আহত হয় অর্ধশত। সংঘর্ষের সময়ে চাষাঢ়ায় সায়াম প্লাজার সামনে প্রকাশ্যে বেধড়ক মারধর করা হয় নিয়াজুলকে। এসমত খোয়া যায় নিয়াজুলের লাইসেন্স করা অস্ত্র। পরে সেটা উদ্ধারও হয় পরিত্যাক্ত অবস্থায়। একই দিন শাহ নিজাম অস্ত্র হাতে নিয়ে গুলি করেছিল। প্রকাশ্য কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল।
আলোচিত মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার আগে অপহরণের পরেই শহরের চাষাঢ়ায় সায়াম প্লাজায় একটি স্থানে নেওয়া হয় দাবী করেছেন নিহতের বাবা রফিউর রাব্বি। তাঁর দাবী মোতাবেক সায়াম প্লাজায় ‘শামীম ওসমানের একজন ক্যাডারের অফিসে ত্বকীকে আটকে রাখা হয়। সেখানে শামীমপুত্র অয়ন ওসমান ও প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানও ছিল।’
রাব্বি বলছেন, রাত ৯টার পর থেকে আল্লামা ইকবাল রোডের উইনার ফ্যাশনে ছিল ত্বকী। সেখানেই হত্যা নিশ্চিত করে লাশ ফেলা হয় শীতলক্ষ্যায়। বিকেল ৪টায় বাসা থেকে বের হয় ত্বকী। বিকেল ৪টা হতে রাত ৯টা পর্যন্ত এ ৫ ঘণ্টা শহরের চাষাঢ়ায় সায়াম প্লাজায় শামীম ওসমানের এক সহযোগির অফিসে আটকে রাখা হয় ত্বকীকে।
আপনার মতামত লিখুন :