যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপিতে ক্রমশ বিশৃঙ্খলা বাড়ছেই। বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা প্রতিনিয়ত হাতাহাতি, মারামারির ঘটনায় জড়াচ্ছেন যা নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। এর আগে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিলেও তাদের নির্দেশ তোয়াক্কা না করেই নেতাকর্মীরা এইসব কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছেন।
তবে এর কারণ হিসেবে মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপুর দক্ষ নেতৃত্বের অভাবকে দুষছেন সবাই।
তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে মহানগরের এই দুই নেতাকে অধিকাংশ নেতাকর্মীরাই মানেন না। সেজন্য কিছুদিন পর র্যালী চলাকালে কিংবা সামনে দাঁড়ানো নিয়ে মারামারির ঘটনা ঘটছে। তা আবার তাদের উপস্থিতিতেই। তারা ধমক দিয়েও বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এর আগে দীর্ঘ দুই বছর ধরে আহবায়ক কমিটি দিয়ে চলছে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির দলীয় কার্যক্রম। যে কমিটিতে আহবায়ক করা হয় অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে এবং অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপুকে সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয়। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর গঠিত ৪৫ সদস্যবিশিষ্ট এই আহবায়ক কমিটির বিরোধীতা করে ছয় দিনের মাথায় ৪ যুগ্ম আহবায়কসহ ১৫ নেতা পদত্যাগ করেন। এর ফলে শুরুতেই এই কমিটিকে বেকায়দায় পড়তে হয়। পরবর্তীতে অন্তকোন্দলের জের ধরে এই কমিটি গত দুই বছরেও সম্মেলন করতে না পেরে ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৫ই আগস্ট ছাত্র জনতার তোপের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহানগরের অন্তত ৫টি স্থানে বিশৃঙ্খলা ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ৩০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির র্যালীতে যুবদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় হাতাহাতি ও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটে। বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি উদ্যোগে এই র্যালির পূর্বে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ চলছিলো। এসময় বন্দর থেকে থানা বিএনপির সভাপতি শাহেন শাহর নেতৃত্বে একটি মিছিল এসে সমাবেশস্থলে যোগ দেন। এসময় তারা পূর্বের অবস্থান নিয়ে থাকা নেতাদের সরিয়ে নিজেরা সামনের দিকে জায়গা দখল করে নেয়। পরবর্তীতে মহানগর যুবদলের যুবদলের আহবায়ক মনিরুল ইসলাম সজল ও সদস্য সচিব শাহেদ আহম্মেদের নেতৃত্বে আরো একটি মিছিল নিয়ে সমাবেশ স্থলে পৌঁছে শাহেন শাহর লোকদের সরিয়ে সজল এবং শাহেদকে সামনে এগিয়ে দেয় তাদের অনুসারীরা। এসময় র্যালির শুরুর জন্য নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছিলেন মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন। সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্য চলাকালীন সময় সজল ও শাহেদের অনুসারীদের সঙ্গে বন্দর থেকে আসা যুবদলের নেতাকর্মীদের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। পরে সাখাওয়াত হোসেন খান সবাইকে নিবৃত্ত করেন। পরিস্থিতি বিশৃঙ্খলা হচ্ছে দেখে মহানগর বিএনপির আহŸায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু দ্রুত র্যালি শুরু করে দিলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরবর্তীতে র্যালিটি বঙ্গবন্ধু সড়কের জাকির সুপার মার্কেটের কাছে পৌঁছালে যুবদলের কিছু সমর্থক যুবদল নেতা মাজহারুল ইসলাম জোসেফকে ধাক্কা দেয়। এ সময় জোসেফের অনুসারীরা তাদেরকে বেদম পিটুনি দিলে যুবদলের মাসুম নামের এক কর্মীর নাক ফেটে গিয়ে রক্তাক্ত জখম হয়। ওই সময় সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। কিন্তু আহত মাসুম নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে এসে অবস্থান নিয়ে পুনরায় জোসেফকে আক্রমন করার চেষ্টা করলে আবারো দুইপক্ষের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরে অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন ও আবু আল ইউসুফ খান টিপুসহ সিনিয়র নেতারা আহত মাসুমকে ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করে র্যালি নিয়ে এগিয়ে যান।
গত ২৮ অক্টোবর তারেক রহমানের নামে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ কর্মসূচীতে বক্তব্য দেওয়া কে কেন্দ্র করে তর্কে জড়াতে দেখা গেছে মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। বিশেষ করে মহানগর বিএনপির আহবায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব আবুল আল ইউসুফ খান টিপু ও মহানগর বিএনপি নেতা রেজা রিপনকে বারবার মেজাজ হারাতে দেখা যায়। বক্তব্য দেওয়া ও মিছিলে সামনে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে তারা একে অপরের উপর চড়াও হয়েছেন।
গত ২৭ অক্টোবর বন্দর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম হিরণকে নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়ায় লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটে। এদিন একদল যুবক মাজহারুল ইসলাম হিরণের উপর হামলা করে। হিরণের সাথে থাকা লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আতাউর রহমান মুকুল ও মদনপুরের সুরুজ মিয়ার অনুসারী কাবিলা ও তার সাথে লোকজন হঠাৎ করেই মাজহারুল ইসলাম হিরণের উপর হামলা করেন।
গত ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে গিয়ে বন্ধন পরিবহনের কয়েক বাস থেকে সিটি বন্ধন এর নাম পরিবর্তন করে শুধু বন্ধন পরিবহন লিখে দেয় তপনের ভাগ্নে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক সাখাওয়াত হোসেন রানাসহ অনুসারী পরিবহন নেতারা। পরে দুপুর ২টায় জাকির খান অনুসারী মহানগর স্বেচ্ছাসেবকদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জিয়ার নেতৃত্বে শতাধিক নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে বাস কাউন্টারের সামনে জড়ো হয়। সেখানে আগে থেকেই থাকা রানার অনুসারীদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন পরিবহন কার্যালয়ে ভাংচুর চালায় ও নেতাদের মারধর করে। পরে বন্ধন পরিবহনের কাউন্টার ও চেয়ার ভাংচুর চালায় খানের সমর্থকরা। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে এলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। বিকেল ৪টায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন চলে গেলে আবারো দুই পক্ষ একে অন্যের উপর হামলা করে। ওই সময়ে কয়েকজনের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে। এতে দুই পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হয়।
গত ৬ সেপ্টেম্বর মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপুর উপর হামলা হয়। এ ঘটনায় পরদিন তিনি নিজেই বাদী হয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি ও নাসিক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশাসহ ২০৩ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। এদিকে টিপুর উপর হামলার ঘটনায় গত ৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপির বিবদমান দু'টি পক্ষ। সকালে কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশার নেতৃত্বে ও বিকেলে অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে টিপুর মামলা জামিন পান আশা, মুকুলরা।
আপনার মতামত লিখুন :