গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিগত দিনে ওসমান পরিবারের পক্ষেই ছিলেন এবং তৎকালের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে সব সময়ে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন এ নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। বিএনপি নেতারাও এটা স্বীকার করলেও পদধারী একটি বড় অংশ নিয়মিত তার গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান ও বিকেএমইএ কার্যালয়ে নিয়মিত ঢু মারছেন। আকুতি বিনতি করে তাঁর কাছে নানা আবদার করে চলেছেন। বিপরীতে হাতেমও নাকে দড়ি দিয়ে বিএনপি নেতাদের নাকানি চুবানি খাইয়ে অনেকটা ভিক্ষাবৃত্তির পর কারখানা ধরিয়ে দিচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিনই হাতেমের কারখানায় সকাল বিকাল চলছে দফায় দফায় বৈঠক। বিভিন্ন এলাকার নেতা যারা আবার বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল সহ সহযোগি সংগঠনে রয়েছে তাদের সঙ্গে হাতেমের এখন গভীর সখ্যতা। বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রকাশ্যেই বলেছেন জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। কিন্তু তাঁর ওই মন্তব্যের পর যেন সখ্যতা আরো বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।
বিএনপির একজন নেতা জানান, তিনি নিজেও হাতেমের সঙ্গে আলোচনা করে একটি গার্মেন্টের ঝুট নামানো বরাদ্দ নিয়েছেন। ফতুল্লা ছাড়াও শহরের নেতারাও নিয়মিত হাতেমের সঙ্গে দেখা করে ঝুট নিতে চান। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন কারখানায় একাধিক গ্রুপ গিয়ে হানা দেয়। তখন অনেক কারখানা মালিক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে পরে চাষাঢ়ায় বিকেএমইএ কার্যালয়ে সভা করেন হাতেম। ছিলেন নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের শীর্ষ নেতারাও। ওই সভাতেই বিএনপি নেতারা হাতেমের উপর দায়িত্ব দেন ঝুট সেক্টর ভাগাভাগি করে দিতে। বিপরীতেও হাতেমও বিষয়টিকে উপভোগ করেন। পরে তিনি সকল বিএনপি নেতারা যারা ঝুট, ওয়েস্টেজ নিতে আগ্রহী তাদের নিয়ে কয়েক দফা বিকেএমইএ ও বিসিকে তার গার্মেন্ট কারখানায় দফায় দফায় বৈঠক করেন। সেখানেই তিনি চূড়ান্ত তালিকা করে দেন। এ কারণে সেপ্টেম্বর থেকে বিসিক, ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলের কারখানায় আর কোন ঝামেলা হচ্ছে না।
ওই নেতা আরো জানান, ঝুট সেক্টর সব সময়ে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রন হয়। কিন্তু এবারই বিএনপি নেতারা টাকার জন্য নিজেদের ব্যক্তিসত্ত্বা বিকিয়ে দিয়েছে। তারা টাকার জন্য হাতেমের কাছে নির্লজ্জের মত সারেন্ডার করেছেন।
এ নিয়ে অবশ্য জেলা বিএনপির সভাপতি গিয়াসউদ্দিন সম্প্রতি কড়া বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিকেএমইএ সংগঠন আছে, সভাপতি পালিয়ে গেছেন। কিন্তু নির্বাহী সভাপতি দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তি এখন ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এই হাতেম স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধান দোসর। তার বক্তব্য-বিবৃতি সব আমাদের কাছে আছেন। তাকে দেখে এখন আপনারা বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যবসা দিয়ে আমাদের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করছেন। মনে রাখবেন, বিএনপির সবাইকে একসাথে করে ফেললেও গিয়াস উদ্দিনের মাথা গিলতে পারবেন না। আপনাদের ছাড় দেওয়া হবে না। অবিলম্বে এই কমিটি ভেঙে দিয়ে যারা ভালো নিরীহ ব্যবসায়ী রয়েছেন তাদের ধারায় কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি থাকলে বিএনপি'র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে, অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে। একটা ব্যবসা বিএনপি নেতার নামে দিয়ে তার সন্তানের নামে হাজারটা ব্যবসা করান। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমার আহবান থাকবে, এই সমস্ত দালালদের বিতাড়িত করে আপনারা নতুন কমিটি গঠন করেন। শেখ হাসিনার পতনে ব্যবসায়ীরা অনেক ব্যাথা পেয়েছে। পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে তারা তৎপর হয়েছে। বিএনপি নেতাদের ডেকে তারা ঝুটের ব্যাবসা দেয়, পাটের ব্যাবসা দেয়। এগুলো তারা ভালবেসে দেয় না। আপনাকে ও আপনার দলকে ধ্বংস করার জন্য তারা এগুলো করছে। দলের ভেতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তারা চেষ্টা করছে। মনে রাখতে হবে ব্যবসায়ীরা সবসময় নিজেদের স্বার্থ চেনে। নারায়ণগঞ্জের যে গডফাদার ছিল তার ভাইয়ের নেতৃত্বে ব্যাবসায়ী সংগঠনগুলো চলত। আজ সেখানে কারা। ওসমান পরিবারের যারা পদলেহন করত তারাই আজ সেখানে আছে। তারা ভাবছে কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে তারা প্রশাসনকে বুঝাতে চাচ্ছে এদের জন্য আমরা ব্যাবসা করতে পারছি না। এদের থেকে আপনাদের বেঁচে থাকতে হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) টানা ১৪ বছর ১ মাস সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন সেলিম ওসমান। ২০১০ সালের ২২জুলাই প্রথমবারের মতো বিকেএমইএ সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই সময়ে সদর ও বন্দর আসনের এমপি বড় ভাই নাসিম ওসমান এবং ফতুল্লা আসনের এমপি চাচী কবরী সারোয়ার ছিলেন। সভাপতি থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে সদর ও বন্দর আসনে উপ-নির্বাচনে এমপি সেলিম ওসমান। এমপি ক্ষমতার সুবাধে বার বার সভাপতি হওয়ার জন্য বিকেএমএই নিয়মও পরিবর্তন করেছেন। গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকার পতন হয়। পরে ২৫ আগস্ট সংগঠনটির এক জরুরি বোর্ড সভায় ১৪ বছর যাবৎ সভাপতি সেলিম ওসমান ব্যক্তিগত কারণ ও অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে তার সভাপতি ও বোর্ড পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার স্থলে নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে সভাপতি দায়িত্ব দেন বোর্ড। তিনি এই সংগঠনের ১নং সদস্য এবং তিনি ডিসেম্বর ১৯৯৬ থেকে ২০০২ পর্যন্ত পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন মেয়াদে সহ-সভাপতি এবং সর্বশেষ দেড় মেয়াদে নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব ছিলেন। জরুরি বোর্ড সভায় ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম নির্বাহী সভাপতি এবং মাইক্রো ফাইবার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ শামসুজ্জামানকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তারা সকলেই বিদায়ী সভাপতি সেলিম ওসমানের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচয় রয়েছেন। নবগঠিত পরিচালচনা পর্ষদে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে রয়েছেন মনসুর আহমেদ। সহ সভাপতি হিসেবে আছেন অমল পোদ্দার, গাওহার সিরাজ জামিল, মোরশেদ সারোয়ার সোহেল সহ-সভাপতি (অর্থ), আখতার হোসেন অপূর্ব, মোহাম্মদ রাশেদ।
আপনার মতামত লিখুন :