কারাগারের অধীনে হাসপাতালের বেডে বসে লোকজনের সঙ্গে দেখা করছেন কারাবন্দী নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসী জাকির খান। শুধু দেখা না বরং সেখানে বসেই ভিডিও কলে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। এছাড়া দেখা করে কয়েকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিও পোস্ট করেছেন। সংশ্লিষ্টদের দাবী এটা আইনের ব্যতয়। আর কারা কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিষয়টি দেখভাল করবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত হত্যাকান্ড ব্যবসায়ী সাব্বির আলম খন্দকার হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। পরে ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত সেপ্টেম্বরে অসুস্থতার কারণে তাকে কারাগার কর্তৃপক্ষ বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিজি হাসপাতাল) ভর্তি করান। তবে তখন থেকেই বাদী পক্ষের আইনজীবীদের অভিযোগ ছিল কারাগার থেকেই অনুসারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন জাকির খান। কিন্তু এতদিন এটার দালিলিক প্রমাণ ছিল না।
৬ নভেম্বর দুপুরে সোহেল রানা মিল্কী নামের জাকির খানের ওই অনুসারী বুধবার বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কয়েকটি ছবি পোস্ট করে লিখেন, আজকে নারায়ণগঞ্জের সিংহ পুরুষ তরুণ প্রজন্মের অহংকার সেই ৯০ সালের সুপারস্টার নারায়ণগঞ্জের গণমানুষের নেতা জাকির খান ভাইয়ের সাথে আমরা মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার তিন ভাই এক সাথে দেখা করলাম। জাকির খান ভাই দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। ছবিগুলোতে দেখা যায়, জাকির খান তার অনুসারীদের সঙ্গে কোনো বাধা ছাড়াই আড্ডা দিচ্ছেন এবং এক নেতার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছেন। যা নিয়ে কারাগার কৃর্তপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মামলার বাদী নিহত সাব্বির আলম খন্দকারের বড় ভাই অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, যদি সাব্বির হত্যার বিচার না হয় তাহলে এই দেশে সাধারণ মানুষ আর বিচার চাইবে না। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চাইবে না। সন্ত্রাসীদের সাথে সকলেই আপোষ করে চলতে চাই নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে। কিন্তু এতে টিকে থাকতে পারবে না। নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য সকলেই সন্ত্রাসীদের পক্ষে কথা বলে। সত্য কথা বলতে চাই না। দেশ থেকে সত্য কথা উঠে গেছে। সাব্বির হত্যার বিচার না হলে সন্ত্রাসীদেরই পুনর্বাসন করা হবে।
নারায়ণগঞ্জ জেল সুপার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, জাকির খানকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে নয়। তাকে ঢাকা কেরানীগঞ্জস্থ কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকার কারাগার কর্তৃপক্ষ বিস্তারিত বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা কেরানীগঞ্জস্থ কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার জানান, আমি এখানে যোগদানের পর থেকে গত ৩ মাসে তাকে কারাগারে পাইনি। সে দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকাস্থ বিএসএমএমইউ (সাবেক পিজি) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আমরা একাধিকবার বার তাকে কারাগারে ফেরত পাঠানোর জন্য চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠির উত্তরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও ২টি চিঠি প্রেরণ করেছে। যাতে উল্লেখ করা হয়েছে জাকির খানের হাঁটুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে সমস্যা রয়েছে। সেজন্য তার চিকিৎসা সম্পূর্ণ হতে আরো সময় প্রয়োজন।
হাসপাতালে অনুগামীদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ওঠার বিষয়ে তিনি বলেন, তাকে বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য নেয়া হচ্ছে। হয়তো সেখানে অনুগামীদের সঙ্গে দেখা হতে পারে। তবে বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমরা খোঁজ খবর নিব।
নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সরকার হুমায়ুন কবির বলেন, জাকির খানের বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে কারাগার কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন। তবে কারাগারে থাকা একজন আসামি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে কারা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণেই থাকতে হবে। এর ফলে কোনো আসামির সঙ্গে কেউ দেখা করতে চাইলে তাকে কারাগার কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি বাদে আসামির সঙ্গে কারো দেখা করা অসম্ভব বিষয়।
এর আগে জাকির খান দীর্ঘদিন ধরে পলাতক ছিলেন। গ্রেফতারের আগে পরিচয় গোপন করে এক বছর সপরিবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসবাস করছিলেন। নারায়ণগঞ্জের একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী জাকিরের বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে। এসব মামলায় বিভিন্ন সময় কারাগারেও ছিলেন। কিন্তু কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি আবার দুর্র্ধষ হয়ে ওঠেন। তিনি নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ এলাকায় বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী ও মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। দেওভোগ এলাকার সন্ত্রাসী দয়াল মাসুদকে হত্যা করে শহরে ত্রাস সৃষ্টি করেন। ২০০৩ সালে সাব্বির আলম হত্যাকাণ্ডের পর তিনি দেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান। এর পর থেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে জাকির দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন। তারও আগে ১৯৯৪ সালে জাকিরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসমূলক অপরাধ দমন বিশেষ আইনে মামলা করা হয়। ওই মামলায় তাঁর ১৭ বছরের সাজা হয়। উচ্চ আদালতে সেই সাজা কমে আট বছর হলেও গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি দেশে ও বিদেশে প্রায় ২১ বছর পলাতক ছিলেন। ২০০৩ সালে সাব্বির হত্যা মামলায় আসামি হওয়ার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। দীর্ঘদিন তিনি থাইল্যান্ডে ছিলেন। পরে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর পরিচয় গোপন করে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক বছর ধরে সপরিবার বসবাস করছিলেন।
জানা যায়, ১৯৯৫-৯৬ সালে জাকির জাতীয় পার্টির প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। নাসিম ওসমানের লোকজনের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে জাকির বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০৪ সালে বিএনপি র্যাব গঠন করলে জাকির দেশ ছেড়ে পালান।
আপনার মতামত লিখুন :