দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে জাতি যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত¡ চুলায় পড়েছে। সারা দেশেই চলছে অরাজকতা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। শিল্প বাণিজ্যের জন্য নারায়ণগঞ্জ বরাবরই এগিয়ে থাকা জনপদ সমূহের অন্যতম। প্রতিদিন বিশাল অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয় বলে অর্থলোভী সন্ত্রাসী বাহিনীর বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডেও সবসময় এগিয়ে থাকে। চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে নারায়ণগঞ্জের নাম। ছাত্র জনতার আন্দোলনে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ায় সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল এবার বোধ হয় এলাকায় শান্তি ফিরে আসবে কারণ দীর্ঘদিন যারা শান্তি বিনষ্টকারী হিসেবে চিহ্নিত ছিল তারা পালিয়েছে বা গা ঢাকা দিয়েছে।
তাছাড়া এবার ক্ষমতায় নির্দলীয় অন্তবর্তীকালীন সরকার আসায় এমন স্বপ্ন দেখা অস্বাভাবিক নয়। দুর্ভাগ্য তেমনটি এখনও হয়নি। শুধু এক সন্ত্রাসীর জায়গা অন্য সন্ত্রাসী দখল করেছে। নির্দিষ্ট কোন দল ক্ষমতায় না এলেও আগের সন্ত্রাসী বাহিনীর লোকজন আতœগোপনে চলে যাওয়ায় শূন্যস্থান পূরণে দুর্বৃত্তের অভাব হয়নি। জাতীয় অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা জেলাটির কুখ্যাতি অক্ষুন্ন রাখতেই যেন সন্ত্রাস হানাহানি চাঁদাবাজি দখলদারিত্বে মেতে ওঠে স্বার্থান্বেষী মহলটি। বিগত সময়ে সাধারণ মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়া বিশেষ মহলের অত্যাচার অনাচারের জায়গায় অবস্থান নেয় নব্য গডফাদার এবং তাদের পোষ্যরা। দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে শুধু ব্যক্তির, কাজের ধারা সেই একই রকম রয়েছে বরং শিথিল আইন শৃঙ্খলা জনিত কারনে তা আরও বেগবান হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছে একই শ্রেণীর ব্যক্তিগণ শুধু পাল্টে গেছে দলীয় পরিচয়।
সন্ত্রাসের জনপদ নামে কুখ্যাতি অর্জন করা নারায়ণগঞ্জের জনগণ আশায় বুক বেঁধে ছিল ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। তাতো হয়নি বরং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ পরস্পর বিপরীত মুখী অবস্থানে থাকায় কিছুটা হলেও প্রতিবাদ হতো, এখন তাও নেই। যে যার মত চর দখলের পদ্ধতিতে সব কিছু নিজের আয়ত্ত্বে নিচ্ছে। দীর্ঘ দিনের ক্ষুধা মেটাতে হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ছে অর্থ উপার্জনের বিভিন্ন অবস্থানে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ক্ষোভের সাথে অনেকেই বলছে এত রক্তক্ষয়ে সরকার পরিবর্তনে কি লাভ হলো? অত্যাচার অনাচারের মাত্রাতো আরও বেড়ে গেল! এমন ধারা অব্যাহত থাকলে অভ্যুত্থানের অর্জন প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষাঙ্গনে চলছে আরেক নব্য সংস্কৃতি, যেখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ছাত্রদের হাতে। শিক্ষক অপসারণ, অপদস্থ করা সহ গায়ে হাত তোলার মত ঘৃণিত কাজও সংঘটিত হচ্ছে। অভ্যুত্থানে ছাত্র সমাজের অগ্রণী ভুমিকা স্কুল কলেজ পর্যায়ের ছাত্রদের মাঝে ভিন্ন, নেতিবাচক বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তারাও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আন্দোলনের আদলে নিজ নিজ এলাকার স্কুল কলেজে বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারাও কিছু করে দেখাতে চায়। এই মানসিকতার কারণে তাদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে শিক্ষক সমাজ। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে সূত্রপাত হলেও সাধারণ জনগণের সমর্থন এবং অংশগ্রহণ ব্যতীত সরকার পতন কখনোই সম্ভব ছিল না। আন্দোলনে প্রাণহানির দিক থেকে ছাত্রদের চাইতে সাধারণ জনতার সংখ্যা কম নয় বরং বেশি। ছাত্রদের প্রশংসনীয় ভূমিকার কারণে তাদের প্রতিনিধিগণ অন্তবর্তী কালীন সরকারের অংশ হতে পেরেছে। দেশ গঠনে তাদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে।
পক্ষান্তরে সাধারণ জনগণ আরো নিপীড়িত হচ্ছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারী আচরণে। তাদের আত্মত্যাগ সর্বোচ্চ হলেও কোন স্বীকৃতি নেই। ছাত্র সমাজের প্রবল প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে অটোপাশের মত ঘৃণিত কাজও এই সরকারকে করতে বাধ্য করা হয়েছে। এদেশের প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা সব সময় ছিল তবে তা কখনোই কোন পদ পদবীর মোহে নয়। ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব সরকারকে সমৃদ্ধ করবে বলেই হয়তো সরকারের অংশ হিসেবে ছাত্রদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাই বলে সাধারণ ছাত্র সমাজ লেখাপড়া ছেড়ে যেভাবে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষ সময়ে তাদের সূচিত আন্দোলন সবার সমর্থন পেয়েছে জাতীয় স্বার্থে। এখনতো তাদের শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যাওয়ার পালা। বিগত দিনের জঞ্জাল পরিষ্কার করে একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে সংঘটিত সফল আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে হলে এখনই সময় এ জাতীয় অত্যাচার, অনাচার, অনিয়ম, হানাহানি, লুটপাট, সন্ত্রাস, যে কোন মূল্যে বন্ধ করা। আইন শৃঙ্খলা পুন:প্রতিষ্ঠা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ছাত্রদের উচিত নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়া। দেশের যেকোন প্রযোজনে তারা আবারও এগিয়ে আসবে এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর আছে থাকবে। অন্তবর্তীকালীন সরকারকে একটি অবাধ নিরপেক্ষ জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে পালন করার সুযোগ তাদের দেয়া উচিত।
এমন ক্রান্তি কালীন সময়ে অন্তবর্তী কালীন সরকার তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হলে তা হবে দেশের ইতিহাসে ঘৃণ্যতম অধ্যায়। যে লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বিগত সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে সে লক্ষ্য অর্জনে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিক তথা রাষ্ট্রের বর্তমান নীতিনির্ধারক মহল নিরপেক্ষ, আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসবেন এমনটি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। এমন প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কোন সুযোগ নেই, তাই যত কঠোর হওয়া প্রয়োজন দেশের কল্যাণে, সাধারণ মানুষের কল্যাণে সরকারকে তাই হতে হবে। নয়তো রক্তক্ষয়ী সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে জেগে ওঠা স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে যাবে, যা কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়।
লেখক: বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা
আপনার মতামত লিখুন :