বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে প্রায় প্রতিবারই অসংখ্য প্রাণহানি, ধ্বংসযজ্ঞ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পালাবদলের পর ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীদের স্বেচ্ছাচারী, সন্ত্রাসী আচরণে সাধারণ মানুষের স্বস্তি উবে যাওয়াও সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। এমন ঘটনার শিকার দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চল, কোথাও কম কোথাও বেশি। ক্ষমতাসীন দলের অত্যাচারে সর্বাধিক অতিষ্ঠ, নিষ্পেষিত এলাকাসমূহের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ অন্যতম।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের প্রধান কাজই যেন চাঁদাবাজি সন্ত্রাস এবং একক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলা। ক্ষমতাসীনদের কথাই যেন এখানে আইন হয়ে যায়। দলের ত্যাগী, সৎ, বিবেকবান ব্যক্তিগণ দলে ঠাঁই পায় না। এদেরকে দলে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়, অনেকে আবার স্বেচ্ছা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। এমন কর্মকাণ্ডের জেরে নারায়ণগঞ্জ এবং সন্ত্রাস যেন একই সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। দলীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে টোকাই, ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে ডাকাত শ্রেণির লোকেরাও দলীয় কর্মী বনে যায়। রাজনীতির "র" বুঝে না এমন শ্রেণির অনেক দুর্বৃত্ত নেতা বনে যায়। রাজনীতি তাদের আদর্শ নয়, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনই তাদের মূল লক্ষ্য। এদের সংখ্যা অতি অল্প হলেও তারাই সবার মাথার উপর ছড়ি ঘুরিয়ে বেড়ায়। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ, সচেতন শিক্ষিত সমাজ এদের কারণে মুখ খুলতে ভয় পায়। দলে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকাই এর অন্যতম প্রধান কারণ।
রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে। সমগ্র দেশবাসীর মতো নারায়ণগঞ্জবাসীও একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের অপেক্ষায় দিন গুনছে। যেখানে থাকবে না কোন সন্ত্রাসী কর্মকা-, চাঁদাবাজি, পরিবার তান্ত্রিক একক ক্ষমতা।
জনশ্রুতি রয়েছে, নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় পদায়ন পেতে কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়। তারা সেই টাকা সুদে আসলে তুলে নিতে জোট বাধে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা কর্মীদের সাথে। দুটি পক্ষই মেতে ওঠে চাঁদাবাজিতে। একইভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় বিভিন্ন টেন্ডার প্রাপ্তি, হাটবাজার ইজারা প্রাপ্তি। শিল্প বাণিজ্যঘন নারায়ণগঞ্জ এই শ্রেণির কাছে সোনার খনি। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে, তবে ঘুরে ফিরে যদি অন্য কোন দলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ঐ শ্রেণির দুর্বৃত্তরা আগের অবস্থানে চলে আসে তাহলে তা হবে পুরনো বোতলে নতুন মদ ঢালার মত। এত রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্য বৃথা বলে প্রতীয়মান হবে। তাদের অবস্থান যেন পুনরুজ্জীবিত না হয় সমগ্র নারায়ণগঞ্জবাসীর এটিই প্রত্যাশা।
"সন্ত্রাসের জনপদ নারায়ণগঞ্জ" কলঙ্কজনক এমন অভিধা থেকে মুক্তি পেতে সমগ্র নারায়ণগঞ্জবাসীকে এক জোট হয়ে কাজ করতে হবে বলে সচেতন মহলের অভিমত। নারায়ণগঞ্জবাসী তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের দাসত্ব আর করতে চায় না। রাজনৈতিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ মানুষই এখন রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে। এমন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা, বাকস্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার, প্রতিটি দলের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক। এমন পরিবেশ তৈরির জন্য জাতীয় পর্যায়ে নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতার যেমন প্রয়োজন রয়েছে, পাশাপাশি দলমত নির্বিশেষে নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি সচেতন মানুষের দায়িত্বও রয়েছে। এমন লক্ষ্য অর্জনে সবাই এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসের জনপদ থেকে শান্তির নারায়ণগঞ্জ প্রতিষ্ঠা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তেমন সুদিনের প্রতীক্ষায় দিন গুনছে শান্তি প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসী।
লেখক : বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা
আপনার মতামত লিখুন :