রমজান হলো ইসলামের একটি স্তম্ভ। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের কাছে পবিত্র এই মাস, যে মাসে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে সারাদিন উপবাস করে থাকেন। এই মাসে রোজাদার ব্যক্তিরা তাদের মন, শরীর এবং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ভোররাত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকেন। শুরুতে অনেক রোজাদারের জন্য নতুন খাদ্যাভ্যাসের সাথে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হলেও মাসের শেষদিকে বেশিরভাগ লোক রোজা থাকাকে সহজ বলে মনে করে।
তবে রমজানের শেষে ঈদ ও ঈদ পরবর্তী দিনগুলি অনেক সময়ে অনভিপ্রেত স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে, কারণ অনেকেই এক মাস বিরত থাকার পরে এসময়ে অতিরিক্ত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করার লোভ সামলাতে পারে না। এটি তাদের শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের জন্য নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। এসব কারণে ঈদের পরে হৃদরোগ, স্ট্রোক, হাই প্রেশার ও বদহজম জাতীয় রোগের প্রকোপ হঠাৎ বেড়ে যেতে দেখা যায়। তাই, রমজান-পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের তাদের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
রমজানের মূল নীতিগুলির মধ্যে একটি হলো আত্মসংযম ও শৃঙ্খলা, এবং এই নীতিটি রমজান-পরবর্তী সময়েও মনে রাখা উচিত। এই পবিত্র মাসের চেতনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরবর্তীতেও স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য গ্রহণের জন্য সবার চেষ্টা করা উচিত। যে কোন অবস্থায় অত্যধিক খাওয়াদাওয়া বা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। পরিবর্তে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার পরিমিতভাবে গ্রহণ করতে হবে যা শরীরের পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে।
এটি অর্জনের সর্বোত্তম উপায়গুলির মধ্যে একটি হলো ধীরে ধীরে নিয়মিত প্রধান খাবার, নাস্তা ও স্ন্যাকসগুলিকে দৈনিক খাদ্যতালিকায় সুষম এবং পরিমিত উপায়ে পুনঃপ্রবর্তন করা। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে রমজান মাসে শরীর দীর্ঘ সময়ের জন্য উপোস অবস্থায় থাকে এবং নিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের সাথে খাপ খাওয়াতে পরিপাকতন্ত্রের জন্য কিছুটা সময় লাগতে পারে।
তাই হঠাৎ করে বেশি পরিমাণে ভরপেট খাওয়া একদম উচিত নয়। বরং সারা দিন অল্প পরিমাণে , ঘন ঘন খাবার খেতে শুরু করা উচিত এবং সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধি করা উচিত। মনে রাখতে হবে, মহানবী কখনো ভরপেট খেতেন না, আর অল্প ক্ষুধা থাকা অবস্থায় খাওয়া শেষ করতেন। খাদ্য গ্রহনের ব্যাপারে এরকম সংযম ভূরিভোজন ও ভরপেট খাওয়া থেকে উদ্ভুত হৃদরোগ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য অনেক রোগ থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।
উপরন্তু ঈদের পরে ৬ দিন ও পরে সপ্তাহে ২ দিন নফল রোজার বিধান এটাই ইঙ্গিত করে যে ঈদের মাধ্যমে রমজানের খাওয়াদাওয়ার সংযম একবারেই শেষ হয়ে যায় না, বরং এই অভ্যাস পরবর্তী মাসগুলোতেও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে উপকারী হতে পারে।
ধীরে ধীরে নিয়মিত খাবার পুনরায় চালু করার পাশাপাশি, খাদ্যের গুণমানের দিকেও মনোযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ফলমূল, শাকসবজি, বিন বা গোটা শস্য এবং চর্বিহীন প্রোটিনের মতো পুষ্টিগুনসম্পন্ন খাদ্যগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, কারণ এই খাবারগুলি শরীরকে সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। প্রক্রিয়াজাত বা উচ্চ-ক্যালোরিযুক্ত খাবার এড়ানো উচিত, কারণ তারা ওজন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
চিনি, লবণ এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটের অত্যধিক ব্যবহার এড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ স্বাস্থ্যের উপর এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব প্রমাণিত, এবং এসব খাদ্য থেকে দীর্ঘস্থায়ী অনেক রোগের উৎপত্তি হতে পারে। পরিবর্তে, খাদ্যতালিকার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যকর খাবার অন্তর্ভুক্ত করা এবং যতটা সম্ভব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া সীমিত করা উচিত ।
রমজান-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের আরেকটি মূল দিক হলো হাইড্রেটেড থাকা। রমজানের সময় দিনের বেলা ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হতে পারে, বিশেষত বেশি গরম কালে রোজা পালন করলে। এই সময়ে ইফতার ও পরে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত। রমজানের পরেও এই অভ্যাস চালিয়ে যাওয়া ভালো। ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হার্ট ও কিডনির ক্ষতি করতে পারে। একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক লোকের প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি বা অন্যান্য তরল খাবার পান করা উচিত। শরীরে পানির ভারসাম্য রক্ষা করার পাশাপাশি অতিরিক্ত খাওয়া বা অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আকাঙ্ক্ষা দমনে এটি সহায়তা করতে পারে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি, রমজান-পরবর্তী সময়ে নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্রিয় রাখাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্যায়াম সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারে। এটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। এমনকি সাধারণ কাজকর্ম যেমন হাঁটা বা গৃহস্থালির কাজগুলিও সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য উপকারী হতে পারে।
ব্যায়ামের পাশাপাশি পরিমিত বিশ্রাম নেওয়া এবং স্ট্রেস-কমানোর জন্য মেডিটেশন করা যেতে পারে। স্ট্রেস এবং ঘুমের অভাব শারীরিক এবং মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং অতিরিক্ত খাওয়া এবং অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলির জন্য দায়ী হতে পারে। অতএব, সকলের উচিত তাদের ঘুম এবং স্ট্রেস-কমানোর কৌশলে গুরুত্ব দেওয়া, যাতে তাদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা বজায় থাকে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘন্টার কম ঘুম দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে।
রমজান-পরবর্তী খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও আত্মনিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা, সংযম এবং ভারসাম্যের মূল্যবোধ প্রতিফলিত হওয়া উচিত যা রোজার মাসের একটি মৌলিক শিক্ষা। ভূরিভোজন বা ভরপেট খাওয়া-দাওয়া বা অনিয়ন্ত্রিত, অস্বাস্থ্যকর বা ভারসাম্যহীন খাবার খাওয়ার পরিবর্তে সবার উচিত স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস রপ্ত করা। বছরের অন্যান্য মাসে রমজান থেকে নেয়া শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে- মানুষ বেঁচে থাকার জন্য খায়, খাওয়ার জন্য।
আপনার মতামত লিখুন :