স্যার তখন ক্লাস নেয়া বন্ধ করেছেন। কিন্তু নিজ ডিপার্টমেন্টে সময় কাটাতেন নিয়মিত। মাঝে মাঝেই নিজ শিক্ষার্থীদের সাথে কথা হতো তার। বার্ধক্যজনিত কারনে ছাত্রদের কাছ থেকে অনেকটাই আড়াল হয়ে যেতে শুরু করেন। স্যারের অনুপস্থিতি আমাকে বেশ নাড়া দিতো। একদিন 'আজকের পত্রিকায়' প্রকাশিত আমার লেখা একটি প্রতিবেদন নিয়ে স্যারকে দেখালাম। স্যার প্রতিবেদনটি পড়ে খুশি হয়ে বললেন 'That's great, i'm gonna keep this paper. Proud of you son'। স্যারের মুখ থেকে শোনা শেষ বাক্য ছিলো এটাই।
বলছিলাম কলা ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন অধ্যাপক ড. সুশীল কুমার দাসের কথা। আমি তাকে পেয়েছিলাম ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে। প্রথম সেমিস্টারে তার শিক্ষার্থী হবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তার পড়ানো টপিকগুলো এখনও স্পষ্ট ভাবে মনে গেঁথে আছে। এই মন্তব্য কেবল আমার একার নয়। সহপাঠী সকলেরই একই অভিমত। এর অন্যতম কারন, তার পড়ানোর দক্ষতা। শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে দেয়ার মত এমন অসাধারন দক্ষতা আমি আগে কখনও পাইনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ছিলো তার বয়স ছিলো প্রায় ৮৬। এর কমবেশী হতে পারে যা সঠিক করে কেউ জানাতে পারেনি। ক্লাসে প্রবেশ করতেন ধীর পায়ে। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা। গায়ে উলের সোয়েটার, পায়ে কেডস। চোখে মুখে অভিজ্ঞের ছাপ। শিক্ষার্থীদের ডাকতেন স্নেহের সাথে। কথা বলার ধরণ এতটাই সুন্দর ছিলো যে তার কথা উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠে। তার ভালোবাসায় মাখানো অনুরোধ ও নির্দেশ সাথে সাথে মেনে নিতো সবাই।
স্যার কখনই আমাদের সামনে তার অতীত ইতিহাস সেভাবে তুলে ধরেননি। তবে জানতাম তিনি প্রায় সহস্রাধিক ইংরেজি সাহিত্যের বই পড়েছেন। মাঝে মাঝেই সেসব বই থেকে দেয়া রেফারেন্স শুনলে প্রচলিত কথাগুলো স্বীকার করে নিতে বাধ্য হতাম। ভাষা জানতেন বেশ কয়েকটি। বিদেশ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন প্রায় সত্তরের দশকে। সবকিছুই ছিলো সিনিয়র ব্যাচের ভাইদের মুখে মুখে প্রচলিত। ফলে এসবের সত্যতা কেবল স্যারের পরিবারের লোকজনই যাচাই করতে পারবেন।
আমি স্যারের প্রতি ভীষনভাবে আকৃষ্ট ছিলাম তার ইতিহাসের উপর পান্ডিত্যে। ব্যক্তিগত ভাবে সংকল্প করে ফেলেছিলাম, অনার্স শেষ হলেই তার কাছে অনুরোধ করবো ইতিহাসের উপর বই লেখার জন্য। আর সেই বই লেখায় স্বেচ্ছাসেবক হয়ে নিজের ভেতর ধারন করতে পারবো কিছুটা। কিন্তু সেই অনুরোধ করার সুযোগটুকুও স্যার দিয়ে গেলেন না। বেশ অপরাধী মনে হয় মাঝে মাঝে। এতটা জ্ঞান সমৃদ্ধ একজন শিক্ষকের কাছ থেকে কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই নিতে পারলাম না। অথচ এমন মানুষ এদেশে হাতে গোনা কয়েকজন বলেই মনে হয় এখন।
পেশাগত কারনে কিছুটা অনিয়মিত শিক্ষার্থী হওয়ায়, স্যারের পছন্দের ছাত্রের তালিকায় আমি ছিলাম না। কিন্তু আমার পছন্দের শিক্ষকের তালিকায় শীর্ষ কজনের মধ্যে তিনি থাকবেন। তার প্রয়ানের সংবাদে স্তব্ধ হয়ে ছিলাম দীর্ঘক্ষন। একজন জ্ঞান সমৃদ্ধ মানুষের কাছে বাড়তি কিছু শিখতে না পারার বেদনা হয়তো আজীবন পীড়া দেবে। একই সাথে পীড়া দেবে শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালোবাসা পুর্ন একজন শিক্ষকের চির বিদায়।
আপনার মতামত লিখুন :