প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ এখন যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। তীব্র যানজটে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। স্থবির হয়ে উঠেছে জনজীবন। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। এরই মধ্যে শহরে ফিটনেস বিহীন গাড়ি নগরীতে না চলা, রাস্তায় লোড আনলোড, অবৈধ পার্কিং বন্ধ, লাইসেন্স বিহীন অটো রিকশা প্রবেশ নিষিদ্ধ করে মাইকিং করা হয়েছে। নির্দেশ অমান্য করলে মামলা দেওয়াসহ নানা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ১৪ নভেম্বর শহরে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ এবং সেনাবাহিনী। চলাচলের অনুমতি না থাকায় গ্রীন ঢাকা ও আশিয়ান পরিবহনের ২ টি এসি বাস, ১ টি লেগুনা, ২ টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ১ টি সিএনজিকে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বন্ধন পরিবহনের একটি বাসকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
তবে একদিন শেষেই আবারো সেই আগের মতই অবস্থা। নগরবাসী বলছেন ধারাবাহিক অভিযান না চালানো হলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক কিলোমিটারের ছোট এই শহরে বিভিন্ন পরিবহনের রেজিস্ট্রিকৃত বাসের সংখ্যা রয়েছে ২৮৩টি। সেই সাথে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ঢাকা-নারায়ণঞ্জ রুটে নতুন করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিনটি পরিবহনের বাস চালু করা রয়েছে। যাদের বাসের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক। যেগুলো নিয়মিত ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে যাতায়াত করে। এর বাইরেও অনেক বাস রয়েছে। যাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একই সাথে বৈধ ও অবৈধ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক রয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার। যেগুলো আগে সচরাচর শহরে প্রবেশ করার সুযোগ পেতো না। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যখন তখন যেভাবে খুশি শহরে প্রবেশ করছে। পাশাপাশি মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যান, ট্যাংক লড়ী, ট্রাক, লেগুনা ও ট্রাক্টর তো রয়েছেই। তাদেরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যার কারণে শহরের রাস্তায় বের হলেই ৫ থেকে ১০ মিনিটের রাস্তায় সময় লাগছে ঘণ্টা পর ঘণ্টা। এদিকে শহরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও একেবারেই নেই বলা চলে। রাস্তার পাশে বিশাল মার্কেট নির্মাণ করা হলেও সেগুলোতে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। আর যেসকল মার্কেটগুলোর নিচে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলোতে পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান, শো-রুম, রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেয়া হয়েছে। ফলে শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাড়ায় দীর্ঘ সময় ধরে সড়কের উপরে গাড়িপার্কিং করে রাখে অসংখ্য প্রাইভেটকার, বাইক। নির্দিষ্ট লেনের গাড়িগুলো পর্যাপ্ত জায়গা না পেয়ে আটকে থাকে দীর্ঘসময় ধরে।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে শহরে বৈধ স্ট্যান্ডের থেকে অবৈধ স্ট্যান্ডের পরিমাণ অনেক বেশী। তাদেরকে যেন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। যত্রতত্র গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্ট্যান্ড। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন কর্তৃক শহরে বৈধ ইজারা দেয়া স্ট্যান্ড রয়েছে মাত্র ৫টি। এছাড়া বাকি যত স্ট্যান্ড রয়েছে সবগুলোই অবৈধভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়াতেই রয়েছে কমপক্ষে ৮টি অবৈধ স্ট্যান্ড। শহরে যানজটের প্রধান স্থানগুলো হচ্ছে চাষাঢ়া চৌরাস্তা মোড়, রাইফেল ক্লাব মোড়, নূর মসজিদ মোড়, পপুলার পয়েন্ট, সায়াম প্লাজা, দিগুবাবুর বাজার রোড, ২ নম্বর রেলগেট, মণ্ডলপাড়া সেতু ও নিতাইগঞ্জ মোড়। মূলত বঙ্গবন্ধু সড়কটি নারায়ণগঞ্জবাসীর ঢাকায় যাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সড়ক। শহরে বহু কারখানা থাকায় সড়কটিতে যানবাহনের চাপ থাকে অনেক বেশি। ওইসকল অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো বছরের পর বছর ধরে বহালই রয়ে যাচ্ছে। একই সাথে রুট পারমিট ও ফিটনেস বিহীন গাড়ি গুলো শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী উঠানো-নামানো করে আসছে। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে বড় ছোট দুর্ঘটনা।
ইসরাফিল হোসেন নামের এক চাকুরিজীবী বলেন, কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন শহরের নিতাইগঞ্জ থেকে রিকশায় চড়ে চাষাঢ়ায় যেতে হয় তাঁকে। তাঁর সঙ্গে কথা হলে বিরক্তির সুরে তিনি বলেন, তীব্র যানজটের কারণে সোয়া দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ৪০ মিনিটেরও বেশি সময় লাগছে। তাই বেশির ভাগ সময় আমাকে হেঁটেই কর্মস্থলে আসতে হয়। তবে হেঁটে আসতেও রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাঁকে। কেননা পথচারীদের জন্য নির্মিত ফুটপাত দীর্ঘদিন ধরে হকারদের দখলে।
তার মতোর বিরক্তি প্রকাশ করে আফসানা আক্তার নামের এক গৃহিণী বলেন, ‘বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য প্রতিদিন আমাকে এই সড়ক ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু কয়েক দিনের তীব্র যানজটের কারণে দীর্ঘক্ষণ সড়কেই সময় নষ্ট করতে হচ্ছে। তীব্র গরমে বাচ্চাদের নিয়ে যানজটের মধ্যে পড়ে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়।’
ভুক্তভোগীরা জানান, শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে এত দিন শুধু অফিস সময়ে যানজট থাকলেও বর্তমানে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। মূলত কয়েক দিন ধরে ঢাকা-চাষাঢ়া লিংক রোডের চাঁদমারী থেকে চাষাঢ়া এবং আদমজী-চাষাঢ়া সড়কের খানপুর থেকে চাষাঢ়া পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে বৈদ্যুতিক তার সংযোগ দেওয়ার কাজ চলমান থাকায় যানজট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।
নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের টিআই এমএ করিম বলেন, আজ থেকে সব সংস্থার সমন্বয়ে আমরা অভিযান শুরু করেছি। যানজট নিরসনে পর্যায়ক্রমে সব ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। চেষ্টা করছি, অচিরেই এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে।
নাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাকির হোসেন জানান, নারায়ণগঞ্জ শহরের যানজট নিরসনে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনসহ পাঁচটি সংস্থা ইতোপূর্বে একাধিকবার সভা করেছি। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চাষাঢ়া এলাকায় কোন বাস কাউন্টার থাকতে পারবেন না। বাস কাউন্টারগুলো চাষাঢ়া থেকে চাঁদমারিতে আজকের মধ্যে সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নয়তো আগামীকাল থেকে আরো কঠোর অভিযান পরিচালিত হবে। আমরা ইতোমধ্যে ২টি বাসসহ কয়েকটি অনুমোদনহীন পরিবহনকে ডাম্পিংয়ে পাঠিয়েছি। একটি পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে। অবৈধ পার্কিং ও স্ট্যান্ড বন্ধে নো পার্কিং জোন করা হয়েছে। অটোরিকশাগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ শহরে ট্রাকগুলো সকাল আটটা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। শহরের যানজট নিরসনে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে।
আপনার মতামত লিখুন :