দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জে সুতা ব্যবসায়ীদের জাতীয় ভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্টস এসোসিয়েশনকে নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসীদের গডফাদার ওসমান পরিবারের প্রভাবে কুক্ষিগত করে রাখা চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ চোরাই সুতা সিন্ডিকেটের হোতা লিটন সাহাকে আটক করেছে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি টিম।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে লিটন সাহাকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারসহ ব্যবসায়িক পাড়ায় লিটন সাহাকে আটকের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ওসমান পরিবারের মদদপুষ্ট চাঁদাবাজ লিটন সাহাকে আটক করায় জনগণের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছে।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলেও এখনো ওসমানদের রাহুমুক্ত হয়নি নারায়ণগঞ্জে সুতা ব্যবসায়ীদের জাতীয় ভিত্তিক সংগঠন ইয়ার্ন মার্চেন্টস এসোসিয়েশন। প্রায় ৩ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পদত্যাগ করেনি বিগত আওয়ামীলীগ শাসনামলে ওসমান পরিবারের আর্শিবাদে ইয়ার্ন মার্চেন্টস এসোসিয়েশনে রামরাজত্ব কায়েম করা লিটন সাহা। পট পরিবর্তনের পরে লিটন সাহা ও তার ভাই রামু সাহা গা ঢাকা দিলেও এখনো ওসমানদের রাহুমুক্ত হয়নি সংগঠনটি। বিগত দিনে যারা ওসমান পরিবারের পদলেহন করে সংগঠনটিতে বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছিল তারা এখনো রয়েছে স্বপদে বহাল। লিটন সাহা ও রামু সাহা পালালেও মুঠোফোনে চলছে তাদের নিরব চাঁদাবাজি। বিশেষ করে বিগত আওয়ামীলীগ শাসনামলে নারায়ণগঞ্জে চোরাই সুতা তথা বন্ড সুতা জালিয়াতির সিন্ডিকেটের গডফাদার বনে যাওয়া লিটন সাহার আর্শিবাদপুষ্টরা এখনো ইয়ার্ন মার্চেন্টসের কমিটিতে আসীন থাকায় টানবাজারে বন্ধ হয়নি চোরাই সুতার কারবার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের আর্শিবাদে লিটন সাহা বনে গিয়েছিলেন সুতা ব্যবসায়ীদের জাতীয় ভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্টের সভাপতি। তার নেতৃত্বে চলেছে চাঁদাবাজি, মদের ব্যবসা, জুয়াসহ নানা অপকর্ম। বিগত দিনে তার নিরব চাঁদাবাজি অনেকটাই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার অন্তত সহ¯্রাধিক সুতা ব্যবসায়ী রয়েছে। রং ও ক্যামিকেলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে অন্তত দেড় শতাধিক। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার সুতা বিকিকিনি হয় এই ছোট্ট টানবাজার এলাকাতেই। এছাড়াও রয়েছে বন্ডের জালিয়াতি বা চোরাই সুতার ব্যবসাও। টানবাজারে বন্ড জালিয়াত ব্যবসায়ীদের গডফাদার ছিল এই লিটন সাহা। লিটন সাহা ও রামু সাহার নেতৃত্বে গত কয়েক বছর ধরে টানবাজারে গড়ে ওঠা চোরাই সুতা সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বন্ড সূতা ক্রয় ও বিক্রয় করার কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়তই লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। টানবাজারে চোরাই সুতা ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে কমতে শুরু করেছে সুতা ব্যবসায়ীদের সংখ্যা। লিটন সাহার বন্ড জালিয়াতির অন্যতম দোসর ছিল আমলাপাড়া এলাকার কাস্টমসের সুজিত সাহা।
বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বন্ড জালিয়াতি মামলায় লিটন সাহার বাবা আসামী হয়েছিল। তবে লিটন সাহা ইয়ার্ন মার্চেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি হওয়া সে ছিল ধরা ছোয়ার বাইরে। কাস্টমসের অভিযানে একাধিক চোরাই সুতা ব্যবসায়ী পাকড়াও এমনকি মামলার আসামী হলেও লিটন সাহা সভাপতি হওয়ায় আসামী হয়নি। ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের আওতাধীন ইয়ার্ন মার্চেন্ট ক্লাব। তবে আওয়ামীলীগ শাসনামলের এক দশক ধরেই সুতা ব্যবসায়ীদের এই ক্লাবটি ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি বিতর্কিত লিটন সাহার নেতৃত্বে আসার পর থেকে নানা কারণে ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে সংগঠনটি। যার মধ্যে অন্যতম ছিল লিটন সাহার শেল্টারে চলেছে অবাধে জুয়া খেলা ও মাদক বিক্রি। এছাড়াও ওসমান পরিবারের আস্থাভাজন হিসেবে ক্লাবের সভাপতি পরিচয়ে দীর্ঘ এক দশক ধরেই লিটন সাহার নেতৃত্বে চলেছে নিরব চাঁদাবাজি।
২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ওই জুয়ার আসর থেকে জুয়া খেলার সময়ে হাতে নাতে ২২ জন জুয়ারীকে গ্রেফতার করেছে যাত্রবাড়ির ধলপুরস্থ র্যাব-১০ এর একটি টিম। এসময় জুয়া খেলার তাস ও নগদ ২ লাখ ৩১ হাজার দুইশত টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে ১৮ এপ্রিল র্যাব-১০ এর হাবিলদার মো: আলমগীর হোসেন বাদি হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় ১৮৬৭ সনের জুয়া আইনে একটি মামলা দায়ের করেন এবং গ্রেফতারকৃতদের সদর মডেল থানায় হস্তান্তর করেন।
একই বছরের ১৪ আগষ্ট ইয়ার্ন মার্চেন্টস ক্লাবে জুয়া খেলার সময়ে ফটো সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেরে হুড়োহুড়ি করে পালিয়েছে একদল জুয়ারী। এর আগে ২০১৯ সালের ৮ মার্চ সন্ধ্যায় সুতা ব্যবসায়ীদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের টানবাজারস্থ কার্যালয়ে অবস্থিত ইয়ার্ন মার্চেন্ট ক্লাব থেকে ১২ জুয়ারিকে আটক করে সদর মডেল থানা পুলিশ।
গত ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের মতো অপকর্মের দোসর লিটন সাহা ও ছোট ভাই রামু সাহাও পালিয়ে গেছে। ৫ আগস্টের পরে নারায়ণগঞ্জ শহরের টানবাজার ও আশেপাশের এলাকায় কুখ্যাত লিটন সাহার বিরুদ্ধে পোস্টার সাটিয়েছে নির্যাতিত ব্যবসায়ীরা। তারা অবিলম্বে লিটন সাহা ও তার দোসরদের গ্রেফতারের মাধ্যমে দৃষ্টানমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। গত ১৭ আগস্ট রাতে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান, শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, শ্যালক বিসিবি পরিচালক তানভীর আহমেদ টিটুসহ ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০০ জনের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা দায়ের করেন নিহত আবুল হাসান স্বজনের ভাই আবুল বাশার অনিক। ওই মামলায় লিটন সাহা ও তার ছোট ভাই রামু সাহাও আসামী। এছাড়াও আরো কয়েকটি মামলাতেও লিটন সাহা আসামী রয়েছে বলে জানা গেছে।
আপনার মতামত লিখুন :