কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার একটি লাইন ছিল ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। এ কবিতার মতই এক চরিত্র রফিউর রাব্বি। এ নামে পরিচিত করতে কোন ধরনের বিশেষণ প্রয়োজন হয় না। এ নগরবাসীর জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে হারিয়েছেন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নাড়ি ছেড়া ধনকে। মামলার শিকার হয়েছেন অসংখ্যবার। প্রভাবশালী প্রতাপশালীদের চোখ রাঙানি, হুমকিতে কোনভাবেই তিনি নুয়ে পড়েনি। ছিলেন অবিচল, এখনো মাথা উচুঁ করেই এগিয়ে চলেছেন। নগরবাসীর নানাবিধ সমস্যায় যখন সকলে থাকে ঘুমে থাকে কিংবা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে তখন তিনি সকলকে জাগিয়ে তুলেন, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ ঝাড়েন। ছুটে যান বিভিন্ন দপ্তরে। জানান নারায়ণগঞ্জবাসীর দাবী।
তবে রফিউর রাব্বির প্রাপ্তি কতটুকু এটা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। লাখো মানুষের এ নারায়ণগঞ্জকে জঞ্জাল দূর করতে একের পর এক ঝুঁকি নিলেও আন্দোলনগুলোতে নগরবাসীর গণসম্পৃক্ততা যে নগন্য সেটাও যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য ব্যক্তিস্বার্থকে সব সময়েই জলাঞ্জলী দিয়েছেন রফিউর রাব্বি।
নগরবাসী মনে করেন, বাস ভাড়া আন্দোলন, দেশের তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া, সন্ত্রাস ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, যে কোন নাগরিক সমস্যায় আন্দোলন, পরিবেশ রক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকা- কোন কিছুতেই বাদ যান না রাব্বি। সে দিক থেকে নানা সময়ে অবমূল্যায়িত রাব্বির হাত ধরেই পরিবর্তনে এক নারায়ণগঞ্জ গড়ে উঠতে পারে। যোগ্য চেয়ারে আসীন করা হলে বদলে যেতে পারে নগরের চিরায়িত দৃশ্যপট। কারণ এ ব্যক্তির নজর পড়েনি এমন কোন সেক্টর বাদ পড়েনি। সবগুলোতেই রয়েছে ছোঁয়া। কোনটিতে আন্দোলন করে দাবী আদায়, আবার কোনটিতে চলমান আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করা বিকল্প আর শহরে তেমন কেউ নাই।
শুধু নাগরিক আন্দোলন না বরং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়েছেন অবিরত। প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে তাদের দোর্দন্ড প্রতাপের সময়ে লড়েছেন তিনি। নগরবাসী তার বক্তব্য শুনেছেন, ভেতরে এক ধরনের প্রতিবাদী অবস্থান গড়ে তুলে ধিক্কার জানিয়েছেন। কেউ হয়তো প্রকাশ্য আসতে পারেনি কিন্তু মৌন সমর্থন আর আশীর্বাদ ছিল রাব্বির প্রতি। ছেলে হারিয়ে বিচারের দাবীর সঙ্গেও যে নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য তিনি লড়েছেন সেটাও দ্বিতীয় কাউকে দেখা মিলেনি। অনেকেই কলিজার টুকরো হারিয়ে নুয়ে পড়েন আবার কেউ আড়ালে চলে যান। কিন্তু অমাবশ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারেও নারায়ণগঞ্জে আলো জ্¦লাতে রাব্বি ছিলেন দিয়াশলাইয়ের মত।
এবার নারায়ণগঞ্জবাসী নতুন করে এক স্বপ্ন দেখছে বাস ভাড়া নিয়ে। ইতোমধ্যে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম বাস ভাড়া কমানোর দাবীতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। ধারাবাহিক কর্মসূচী চলমান, জনমত গঠনে প্রচারণা চলছে। গণমানুষ ভাড়া কমানোর পক্ষে, তবে আওয়াজ প্রকাশ্য কম। দাবী না মানলে আসছে হরতাল।
তবে এবারই প্রথম না। বাস ভাড়া কমানোর দাবীতে আলোচিত ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে। তখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটসহ নারায়ণগঞ্জের অভ্যন্তরের বিভিন্ন রুটের বর্ধিত বাসভাড়া কমানোর দাবিতে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম ২০ জুন শহরে আধাবেলা হরতাল আহ্বান করে। ১৫ জুন নারায়ণগঞ্জের ২২৫ জন আইনজীবী যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। হরতালের সমর্থনে গত ১৫ দিন ধরে নারায়ণগঞ্জে সমাবেশ-মিছিল হয়। হরতালের পক্ষে পোস্টার লাগানো এবং হ্যান্ডবিল বিতরণ করতে গিয়ে পরিবহন সন্ত্রাসীদের হাতে ৩ দফা হামলার শিকার হয় হরতাল সমর্থকরা। এতে আহত হয় ৫ জন। পরে ডিসি অফিসে এক সভায় শুরু থেকেই শামীম ওসমান ও পরিবহন মালিকরা ছিলেন মারমুখি অবস্থানে। সেদিন তখনকারী এমপি সারাহ বেগম কবরী, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে শারীরিক লাঞ্ছিত করেন শামীম ওসমান।
আইনজীবীদের হাত থেকেও রক্ষা পাননি রাব্বি। ২০২১ সালে তার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করেন আইনজীবী সমিতির নেতারা।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে। এরপর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী সংলগ্ন কুমুদিনী খাল থেকে তার ক্ষত বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় রফিউর রাব্বী বাদী হয়ে সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। ১৮মার্চ রাতে রাব্বি হত্যাকান্ডের ঘটনায় শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম ভূইয়া পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগ সহ সভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমান এর নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারের কাছে অবগতি পত্র দেয়। দীর্ঘ বছর ধরে র্যাব ওই মামলার তেমন কোন তদন্ত করেনি। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে তৎপর। ইতোমধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ধারা চলমান থাকলে রাব্বির দীর্ঘদিনের আন্দোলন যেমন আশার আলো দেখবে তেমনি নারায়ণগঞ্জবাসীও একটি ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে অন্তত মনকে সান্তনা দিতে পারবে।
কারণ ত্বকী হত্যার পরের বছর র্যাবের খসড়া চার্জশীটে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী বামপন্থী একজন নেতা ও সাংস্কৃতিক জোটের সংগঠক। এছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন সংগঠক। সিটি নির্বাচনের সময় মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালান তিনি। এতে প্রতিপক্ষরা তার উপর ক্ষীপ্ত ছিল। এছারা ঢাকা নারায়ণগঞ্জে যাত্রী পরিবহনের মালিকরা অনৈতিক ভাবে বাসভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন তিনি। এতেও ক্ষুব্ধ ছিল স্বার্থন্বেষী মহল তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল। এসব কারণেই তার ছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রবীণ আইনজীবী খোকন সাহা একই ইস্যুতে রফিউর রাব্বির বিরুদ্ধে ১৫ জুন একটি সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। ওই জিডির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন খোকন সাহা।
রাব্বির কণ্ঠরোধ আর থামানোরও চেষ্টা করেছিল হেফাজতে ইসলামের লোকজন। নগরীর চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিষয়ে কটূক্তির অভিযোগ এনে ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল ফৌজদারি কার্যবিধির ২৯৮ ধারায় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির বিরুদ্ধে হেজাজতে ইসলাম জেলা কমিটির সমন্বয়ক মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান আদালতে মামলা করেন। রাব্বিকে গ্রেফতারের দাবি ২১ এপ্রিল সমাবেশ হয়। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে জেলা হেফাজতে ইসলামের এক নেতার মামলা ‘নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মুসলমান’ ব্যানার নিয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে এ দাবি ওঠে। সমাবেশে উপস্থিত হয়ে এ দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের তখনকার সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তিনি বলেন, ‘মঞ্চ থেকে যে দাবি উঠেছে, আমিও তার সঙ্গে একমত। প্রতিবেদনে যদি রফিউর রাব্বীকে অভিযুক্ত করা হয়, তখন প্রশাসন কোনও ধরনের গাফিলতি করলে আমি নিজেই মাঠে নামবো। এমপি-মন্ত্রী আমার কাছে বড় না। ইসলামের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে শামীম ওসমান কখনও আপোস করবে না। নারায়ণগঞ্জে ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করা হলে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না।’
হামলার শিকার হয়েছিলন রাব্বি নিজেও। ২০১৪ সালের ২০ জুন রাব্বি ও তাঁর সহকর্মীদের ওপর হামলা হয়। বেশ কয়েকজন নারী কর্মী শ্লীলতাহানির শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে। হামলায় রাব্বিসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। নগরের কালীরবাজার চারারগোপ এলাকায় ত্বকী মঞ্চের লিফলেট বিতরণের সময় পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলার এ ঘটনা ঘটে।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রার্থী সেলিম ওসমানের সমর্থক জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা এ হামলা চালিয়েছেন বলে রাব্বি ও তাঁর সহকর্মীদের দাবি।
আপনার মতামত লিখুন :