বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহূত সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের চাঁদমারীতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জের গিয়াসউদ্দিন ইসলামিক মডেল কলেজ থেকে এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থী জুবায়ের হোসাইন। পুলিশের বেধড়ক পিটুনিতে যেমন বাম পা প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে তেমনি গুলিতে পেটের খাদ্যনালি ফুটো হয়ে একাধিকবার অপারেশন হলেও ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয়ে গেছে। গত ৭০ দিন ধরে চিকিৎসাধীন থাকা জুবায়ের রয়েছেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। যক্ষের ধন একমাত্র সন্তানকে বাঁচাতে জীবনযুদ্ধে নেমেছেন বাবা মাও। প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে ছেলের সঙ্গে সঙ্গে ঘরছাড়া রয়েছেন তারাও। হাসপাতালই যেন তাদের বসতবাড়িতে পরিণত হয়েছে।
আহত জুবায়েরের মা মালিহা ইসলাম মুঠোফোনে জানান, গত ৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার চাঁদমারীস্থ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ জুবায়েরকে বেধড়ক লাঠিপেটা করে গুলি করে। তখন অন্যান্য শিক্ষার্থীরা জুবায়েরকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু জুবায়েরের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে। বিকেলে তারা খবর পান জুবায়েরকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পাগলা এলাকা থেকে তারা অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন। এরপর জুবায়েরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক জুবায়েরের কোন চিকিৎসা হয়নি। পরদিন ৫ আগস্ট ভোরে জুবায়েরের অপারেশন হয়। চিকিৎসকরা জানান গুলিতে জুবায়েরের খাদ্যনালি ফুটো হয়ে গেছে। এজন্য অপারেশন করতে হবে। অপারেশন করে জুবায়েরের পেট কেটে টয়লেটের রাস্তা দিয়ে লাগানো হয় কলস্টমি ব্যাগ। পুলিশের বেধড়ক পিটুনিতে পাঁজরের হাড় গুড়ো হয়ে গেছে। এখনো বসতে পারে না। বাম পাশ অবশ হয়েছে। পরবর্তীতে ইনফেকশন হয়ে যায় এবং পুনরায় অপারেশন করে ২১ আগস্ট। এছাড়া হাতে গুলি লাগার কারণে সেখানেও ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। জুবায়েরের অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় ২২ আগস্টে সিএমএইচে ট্রান্সফার করা হয়। সেখানে গত ১৫ সেপ্টেম্বর আরও দুইটি অপারেশন হয়। হাতের ক্ষত প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। তবে গত সপ্তাহে পেটের সেলাইয়ের ক্ষত শুকালেও ভিতরে ইনফেকশন হয়ে শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় গত সপ্তাহে ৪ দিন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ক্ষতস্থান থেকে অনেক দূষিত রক্ত ও পুঁজ বের করা হয়েছে। বর্তমানে অবসারভেশনে আছে জুবায়ের।
মালিহা আরও বলেন, আমার স্বামী গাড়ি চালাতো কিন্তু গত ৪ আগস্ট থেকে আমাদের দিন কাটছে হাসপাতালে। ৪ আগস্ট থেকেই ঘরছাড়া হইছি। চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়া অনেক টাকা ঋণ হইয়া গেছি। এখন হাসপাতালই যেন আমাগো বাড়িঘর। অনেকদিন হইছে বাইরের আলো চোখে দেখি না।
জুবায়েরের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন মুঠোফোনে জানান, সে গেল বছর এইচএসসি পাশ করে পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েছিল। তিনি রাজধানী ঢাকায় একটি লোকাল গাড়ি চালিয়ে সংসার চালাতেন। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে তার কাজ নেই বললেই চলে। এর মধ্যে গত ৪ আগস্ট থেকে তিনি ও তার স্ত্রী হাসপাতালেই রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতেই ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দীর্ঘ ৭০ দিন ধরেই হাসপাতালে অবস্থান করছেন তারা। ছেলেকে সুস্থ করতে আত্মীয় স্বজন পরিচিতজনদের কাছ থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়েছেন। আশেপাশের এলাকাবাসীও নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও খোঁজ খবর নিয়েছেন। সিএমএইচে সরকারি খরচে চিকিৎসা চললেও প্রতিদিন তাদের ও সন্তানের খাবার বাবদ দেড় হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। তাদের স্বামী স্ত্রীর খাবার ছাড়াও সন্তানের জন্য প্রতিদিন ৭ থেকে ৮শ’ টাকার ফল কিনতে হচ্ছে। বর্তমানে খরচ জোগাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারিভাবে তাদেরকে ১ লাখ টাকা সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা কবে পাবেন তারা জানেন না। আর এদিকে জুবায়েরের সুস্থ হতে আরও কত দিন লাগবে সেটাও তারা নিশ্চিত নন। এই অবস্থায় তিনি চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। জুবায়েরের চিকিৎসা সহযোগিতায় বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানান জুবায়েরের বাবা জাহাঙ্গীর (০১৩২৭২৫২৬৪৬)।
আপনার মতামত লিখুন :