নারায়ণগঞ্জ জেলা তথ্য সিটি কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বন্দর চিরদিনই বৈষম্যের শিকার হয়েছে। নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বন্দরবাসীর হাহাকার চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা অঞ্চলসমূহের অন্যতম বন্দরে এমন কিছু সরকারি বেসরকারি অবকাঠামো রয়েছে যা দেশ ও জাতির জন্য অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। শিল্পাঞ্চল সমৃদ্ধ বন্দরে রয়েছে দেশের প্রথম মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান বিআইএমটি, জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের প্রথম প্রতিষ্ঠান সোনাকান্দা ডকইয়ার্ড, একমাত্র ডেক ও ইঞ্জিনকর্মী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ডিইপিটিসি। পাটকাঠি দ্বারা নির্মিত বোর্ড-পারটেক্স-তৈরির প্রথম কারখানা। সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বেশকটি কেন্দ্র, বেসরকারি ডকইয়ার্ড এবং সিমেন্ট তৈরির বেশকটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরবর্তী বন্দরে অবস্থিত। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ ছাড়াও এখানে রয়েছে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। ভৌগলিক অবস্থান এবং নদী তীরবর্তী হওয়ায় এলাকাটি প্রাচীনকাল থেকেই শিল্প বাণিজ্যে সমৃদ্ধ। এসব শিল্প বাণিজ্যের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকেই এখানে আসে কর্ম সংস্থানের উদ্দেশ্যে।
কালক্রমে বন্দর পরিণত হয় ধারণ ক্ষমতার অধিক জনবহুল অঞ্চলে। বন্দরের অধিকাংশ শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত, তাই শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জ তথা বন্দরের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ বলা যায়। সেই শীতলক্ষ্যা দেশবাসীর কাছে আশীর্বাদ হিসেবে এখনও অবদান রাখলেও ধীরে ধীরে বন্দরবাসীর জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। নদীটির উত্তর এবং দক্ষিণ প্রান্তে দুটি সেতু থাকলেও তা প্রতিদিন নদী পারাপার হওয়া সাধারণ মানুষের কোন কাজেই আসছে না। জেলা শহর নারায়ণগঞ্জ বা ঢাকা যাতায়াতের সহজ, অর্থ ও সময় সাশ্রয়ী একমাত্র পথ ১নং খেয়াঘাট। নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার যোগে যাত্রীদের জীবন হাতে নিয়ে নদী পার হতে হয়। দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংবাদ নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১নং ঘাট সংলগ্ন কদম রসুল সেতুর কাজ একনেকে পাশ হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখলো না। ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত যে জটিলতা ছিল তাও কেটে গেছে বলে জানা যায়। অবকাঠামো নির্মাণের প্রাথমিক সব কাজও সম্পন্ন হয়েছে। তাহলে এখনও কেন কাজ শুরু হচ্ছে না? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বহুল কাক্সিক্ষত সেতুটির কাজ শুরু করবেন তেমনটিই বন্দর তথা সমগ্র নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রত্যাশা।
বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বন্দরবাসী বঞ্চনার শিকার। গ্যাস স্বল্পতার কারণে সমগ্র দেশবাসী ভোগান্তিতে আছে একথা স্বীকার করেও বলতে হয় বন্দরবাসী গ্যাস সংকট নয় গ্যাস শূন্যতায় ভুগছে। বছরের পর বছর গ্যাস না পেয়েও গ্যাস বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে। বেশ কিছু এলাকায় পানি সরবরাহ শূন্যের কোঠায়, এক্ষেত্রেও বিনা পানিতে পানির বিল গুনতে হচ্ছে। চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা প্রাপ্তির সামান্যতম সুযোগ নেই। বিনা চিকিৎসায় বা চিকিৎসায় বিলম্ব জনিত কারণে অনেককেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে জনবহুল শিল্প সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল দীর্ঘদিন যাবৎ বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছে যার সমাধান কোন কালেই হয়নি, কোন দৃশ্যমান উদ্যোগও চোখে পড়েনি। যা হয়েছে তা কেবল ছেলে ভুলানো আশ্বাস আর আশ্বাস। ছেলে ভুলানো আশ্বাস কবে বাস্তবে রূপ নিবে তাও অজানা।
সুদীর্ঘকাল যাবৎ চরম বৈষম্যের শিকার বন্দরবাসীর নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে যে সরকারই এগিয়ে আসবেন দলমত নির্বিশেষে তাদের স্থান হবে এলাকাবাসীর মনের মনি কোঠায়। নাগরিক সমস্যা সমাধানে শৈথিল্যের কারণ হিসেবে রাজনৈতিক দলাদলি এবং আন্তঃদলীয় কোন্দলকে অনেকেই সামনে আনেন। এখনতো সে সমস্যা নেই তাহলে বন্দরবাসী আশা করতেই পারে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটবে।
কিছু সমস্যার সমাধান স্বল্প সময়ে সম্ভব যা এখনই মিটিয়ে ফেলা যেতে পারে, দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্পগুলোর কাজ যত দ্রুত সম্ভব দৃশ্যমান করা উচিত বলে সচেতন মহলের ধারণা। বন্দরবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হলে তা শুধু বন্দরবাসীর কাজেই আসবে না উপকৃত হবে সমগ্র নারায়ণগঞ্জবাসী। কদম রসুল সেতুর বাস্তবায়ন মূল শহরকে বন্দর পর্যন্ত বর্ধিত করবে। নারায়ণগঞ্জের উপর চাপ অনেক কমে যাবে যা প্রকারান্তরে নারায়ণগঞ্জকে গড়ে তুলবে আধুনিক একটি শহর হিসেবে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে নারায়ণগঞ্জ শহরকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, আবাসন এবং শিল্পায়নের কারণে জেলার মূল শহর পরিণত হয়েছে বসবাস অযোগ্য নগরীতে। তাই সময় এসেছে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জকে সম্প্রসারিত করা এবং ঢেলে সাজানোর। শহর সম্প্রসারণ সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে। নদীর পশ্চিম অঞ্চলে সম্প্রসারণের আর তেমন কোন সুযোগ না থাকায় নজর দিতে হবে নদীর পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ বন্দরের দিকে, যা নারায়ণগঞ্জকে দিতে পারে সমৃদ্ধ আধুনিক বাসযোগ্য শহরের মর্যাদা। বন্দরবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বন্দরসহ সম্প্রসারিত নারায়ণগঞ্জ হবে প্রকৃত অর্থেই স্বপ্নের শহর। বন্দরবাসীর দুঃখ লাঘব করে সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন এমনটিই এলাকাবাসীর প্রত্যাশা।
লেখক : বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা
আপনার মতামত লিখুন :