ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। ইচ্ছা ছিল আকাশে ওড়ার। কিন্তু কালার ব্লাইন্ড সমস্যা থাকায় তার সেই স্বপ্ন এক নিমিষেই চুরমার হয়ে যায়। তার মতো এভাবে অন্য কারো যেন স্বপ্ন শেষ না হয়ে যায় এ থেকেই বর্ণান্ধদের জন্য একের পর এক আবিষ্কার করে আসছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এক শিক্ষার্থী। যার নাম সাইফ উদ্দিন আহমেদ (২৪)।
কালার ব্লাইন্ডদের জন্য প্রথমে গ্লাস এরপর স্কিন প্রটেক্টর আবিষ্কার করার পর সর্বশেষ লেন্স আবিষ্কার করেছেন তিনি। যে লেন্সের মাধ্যমে কালার ব্লাইন্ডদের কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। কালার ব্লাইন্ডে আক্রান্ত যেকোনো ব্যক্তি এই লেন্স পরে নির্ধিদ্বায় স্বাভাবিকভাবে সকল কাজকর্ম করতে পারবেন।
এর আগে, ২০২২ সালে তার আবিষ্কৃত গ্লাসটির নাম দেন তিনি ‘ভাইব্রেন্ট’। যে গ্লাসের তৈরি চশমা দিয়ে কালার ব্লাইন্ডরা পৃথিবীকে রঙিনভাবে দেখতে পারবেন। শনাক্ত করতে পারবেন বিভিন্ন রং। সেই গ্লাসটি বর্তমানে সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। আর ২০২৩ সালে তার আবিষ্কৃত স্কিন প্রটেক্টরের মাধ্যমে ক্লালার ব্লাইন্ডরা মোবাইলের বিভিন্ন রঙ সহজেই চিহ্নিত করতে পারবেন। এছাড়া সহজেই মোবাইলের বিভিন্ন প্রোগ্রামের কাজ করা সম্ভব হবে। এই স্কিন প্রটেক্টরের দেশের বাইরে বেশ চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে।
জানা যায়, সাইফ উদ্দিন আহমেদ নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার আজমেরীবাগ এলাকার বাসিন্দা। ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জের নিউক্লিয়াস স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১৯ সালে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার পর ‘গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমিতে’ পরীক্ষা দিয়ে জানতে পারেন কালার ব্লাইন্ডে আক্রান্ত তিনি। তখন তিনি এর চিকিৎসার জন্য অনেক ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। কিন্তু কোথাও তার এই রোগের কোনো চিকিৎসা তিনি পাননি। এ নিয়ে তার মধ্যে অনেক হতাশা কাজ করলে তখন থেকেই তিনি বর্ণান্ধদের জন্য কিছু করার প্রতিজ্ঞা করেন। সে থেকেই তিনি ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হোন। কারণ সাইফের মতে, নতুন কোনো রোগের উৎপত্তি ঘটলে ফার্মাসিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকেন।
সাইফ উদ্দিন আহমেদের বিশ্বাস, কালার ব্লাইন্ডদের জন্য এই লেন্স তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছেন। সেইসঙ্গে বহির্বিশ্ব যদি তার লেন্সের বিষয় জানতে পারে তাহলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি।
লেন্স নিয়ে সাইফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কালার ব্লাইন্ডদের জন্য ভাইব্রেন্ট গ্লাস ও স্কিন প্রটেক্টর আবিষ্কারের পর আমার চিন্তা ভাবনাকে আরও প্রসারিত করার চেষ্টা করি। কালার ব্লাইন্ড মানুষগুলোকে আরও যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সে সকল সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করি। তারই অংশ হিসেবে এবার লেন্স নিয়ে এসেছি।
এই লেন্সের উপকারিতা বলতে গিয়ে সাইফ উদ্দিন বলেন, কালার ব্লাইন্ড গ্লাস পড়লে সহজেই বুঝা যায়। গ্লাস পড়লে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে আমার এই লেন্স পড়লে কেউ আর বুঝতে পারবে না যে, তিনি কালার ব্লাইন্ড। সেইসাথে লেন্স পড়েছে এটা কেউ বুঝতেও পারবে না। কারণ লেন্সেরও একটি আলাদা কালার রয়েছে। যার কারণে লেন্স পড়লে বুঝা যায়। কিন্তু আমার লেন্স পড়লে কেউ বুঝবে না। কারণ এর কোনো কালার নেই। এই লেন্স চোখের মনির সাথে একেবারে মিশে যাবে। ফলে কোনো রকমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। আর চোখেরও কোনো সমস্যা হবে না।
লেন্স সম্ভাবনা সম্পর্কে সাইফ বলেন, এই লেন্স বাংলাদেশের কোথাও পাওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের এই লেন্সের সাথে পরিচিত হতে পারেননি। যদিও বাংলাদেশের মানুষ কালার ব্লাইন্ড নিয়ে এতটা সচেতন নয়। তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কালার ব্লাইন্ড নিয়ে অনেক সচেতন।
তিনি আরও বলেন, আমার ইচ্ছা এটি প্রত্যেক কালার ব্লাইন্ডদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেলে আমি আমার লক্ষ্য পূরণ করতে পারবো। যদি কেউ যাচাই করে দেখতেও চায় তাহলে আমি প্রমাণ করে দেখাবো। আমি চাই না যেন আমার মতো কারও স্বপ্নভঙ্গ হয়। তারা পৃথিবীকে রঙিনভাবে দেখুক, জানুক।
সাইফের আবিষ্কার প্রসঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সাইফ উদ্দিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব। সে কালার ব্লাইন্ডদের জন্য একের পর এক বিভিন্ন বিষয় আবিষ্কার করছেন। সে নিজেও একজন কালার ব্লাইন্ড। সে এটা ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছেন। সেইসঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা কালার ব্লাইন্ড আছেন তারাও সাইফের প্রত্যেকটা আবিষ্কার দ্বারা উপকৃত হচ্ছেন। এখন সে লেন্স আবিষ্কার করেছেন। আশা করি, এটাতেও সে সফল হবেন। আমি সবসময় তার মঙ্গল কামনা করি।
আপনার মতামত লিখুন :