নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার গোপনগর মন্ডলবাড়ি ব্রিজ সংলগ্ন দুধ বাজার। স্থায়ীত্ব মাত্র কয়েকঘণ্টা। আর দশটা রকমারি পণ্যের জন্য নয়, শুধুমাত্র গাভির দুধের জন্য বিখ্যাত ও নির্ভরশীল একটি স্থান এই দুধবাজার। ৫০ বছরের পুরনো এই বাজারে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার লিটার দুধ বিক্রি হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে বড় দুধবাজার এটি। নারায়ণগঞ্জসহ আশেপাশের এলাকা থেকে আসা মিষ্টি ব্যবসায়ী, পাইকাররাসহ স্থানীয় দুধ ব্যবসায়ীরা দুধ কিনতে প্রতিদিন এখানে ছুটে আসেন। দুধ বেচাবিক্রির জন্য বিখ্যাত হয়ে যাওয়ায় মন্ডলবাড়ি এলাকা এখন সবাই দুধবাজার এলাকা নামেই চিনে থাকেন। বাজারটিতে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ১৫ লাখ টাকার দুধ বিক্রি হয়ে থাকে। এ হিসেবে মাসে বিক্রি হয় প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার দুধ। পূর্বের তুলনায় বর্তমানে দুধের দাম বাড়লেও দুধের মান এখনো আগের মতোই সেরা রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে শুরু হয় দুধ কেনাবেচা, চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। এরপর বিরতি দিয়ে আবার বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দুধ কেনাবেচা চলে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই দুধবাজারকে কেন্দ্র করে আশেপাশের অন্তত ২০টি এলাকায় ছোট-বড় শতাধিক খামার গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। এই দুধের বড় একটি অংশই দুধবাজারে বিক্রি হয়ে যায়। বাকিটা ক্রেতারা সরাসরি খামারে এসে কিনে থাকেন। এর ফলে দুধবাজারকে ঘিরে কয়েক শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। বাজারটিতে কেউ দুধ কিনছেন মিষ্টির দোকানের জন্য আবার কেউ বাড়িতে খাওয়ার জন্যও দুধ কিনে থাকেন। ভেজালমুক্ত ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এটি বিশ্বস্থ বাজারে পরিণত হয়েছে।
দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এই বাজারে দুধ কিনতে আসেন মিষ্টি ব্যবসায়ী জামাল হোসেন। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, মিষ্টি তৈরির জন্য দৈনিক তার ৫০ মণ দুধের প্রয়োজন। দুধের এই পুরো চাহিদাটাই তিনি এই বাজার থেকে মিটিয়ে থাকেন। দুধের মান ভালো হওয়ায় অন্য কোথাও থেকে দুধ কেনার চিন্তা কখনোই করেন না তিনি।
রফিকুল ইসলাম। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে শহরের দেওভোগ এলাকায় বাসায় বাসায় গিয়ে দুধ বিক্রি করে থাকেন। তিনি বলেন, এখানে প্রতি লিটার দুধ ৭৫-৮০ টাকায় কেনা হয়ে থাকে। আর ৯০ টাকায় বিক্রি করে থাকি। এ দিয়েই আমার পরিবার চলে। লাভ কম থাকলেও দুধ বেশি বিক্রি হওয়ায় তেমন পরিবার নিয়ে চলতে তেমন কষ্ট হয় না। দিন দিন দুধের চাহিদা বাড়ায় একেক দিন একেক পরিমাণ দুধ কিনতে হয় বাজারটি থেকে।
জুয়েল মিয়া নামের এক গরু খামারি বলেন, বর্তমানে তার খামারে ১৫টি গরু রয়েছে। প্রতিদিন সকালে ৫০ কেজি এবং বিকেলে ৪০ কেজি দুধ বিক্রি করে থাকি। বাজারটিতে ক্রেতাদের চাপ সবসময় থাকায় দুধ বিক্রি করতে আমাদের অন্য কোথাও যেতে হয় না। তবে বর্তমানে গরুর খাবারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দুধ বিক্রি করে আমাদের লাভ সীমিত থাকে।
জাহাঙ্গীর হোসেন নামের গোপনগর এলাকার আরেক গরু খামারি বলেন, এই বাজারটি ৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। পূর্বে খামার থেকে উৎপাদিত দুধ আমার বাবা এই বাজারে এনে বিক্রি করতো। এখন আমি করে থাকি। একসময় বাজারে প্রতি লিটার দুধ ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকতো। কিন্তু এখন সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ৭০-৮০ টাকায় প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করা সম্ভব হয়।
গোগনগর ইউনিয়নের লাইভস্টক সার্ভিস প্রোভাইডার (এলএসপি) শারমীন আক্তার বলেন, বাজারটি দীর্ঘদিনের পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী এক বাজার। এখানে তিনটি ইউনিয়নের কয়েক শতাধিক খামারি দুধ বিক্রি করে থাকেন। পাশাপাশি বাজারটির আশেপাশে প্রায় ৫ শতাধিক ডেইরি খামার থাকায় দুধের চাহিদা দিনের পর দিন বাড়ছেই। এছাড়া শহরে বর্তমানে ভেজালমুক্ত দুধ পাওয়া অনেকটাই দুষ্কর। এই বাজারটিতে ভেজালমুক্ত দুধ পাওয়া সহজলভ্য হওয়ায় দূর দূরান্ত থেকেও ক্রেতারা দুধ কিনতে এখানে এসে থাকেন। তাদের পাশাপাশি বড় বড় কোম্পানিগুলোও এখান থেকে দুধ কিনে নিয়ে যায়। এখানে এমনও খামারি আছেন যারা প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ লিটার দুধ বিক্রি করেন। তাই এই বাজারে ৫০০ মণ দুধ বিক্রি হওয়া অবাস্তব কিছু নয়।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, এই দুধ বাজারটি অনেক প্রসিদ্ধ একটি বাজার। এই বাজার শুরু হওয়ার পর এটাকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় কয়েক শতাধিক খামার গড়ে উঠেছে। এখানে দুধ বিক্রি করে তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :