ছেলেরা বেঁচে থাকতে ছেলেরাই সংসারের খরচ চালাতেন। মা পারুল বিবির কোনো কাজকর্ম করতে হতো না। শুধুমাত্র ঘরের ভিতরেই তিনি কাজ করতেন। অনেক সময় ঘরের কাজেরও সহযোগী হতেন ছেলেরা। কিন্তু বর্তমানে দুই ছেলে বেঁচে না থাকায় পারুল বিবিকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। তাকে দিন-রাত টিউশনি করে সংসারের খরচ চালাতে হয়। সেইসাথে এই টিউশনির টাকা থেকে ছোট ছেলের মাদরাসার খরচ দিতে হয়।
যার কথা বলা হচ্ছে তিনি হলেন ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত জুবায়ের ও সাব্বিরের মা। সেদিন রাতে তারা এশার নামাজ আদায় করতে গিয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ হয়েছিলেন। সেইসাথে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর তাদের মৃত্যুতে মা পারুল বিবি অসহায় হয়ে পড়েছেন।
পারুল বিবির বর্তমান অবস্থা জানতে তার বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। বাসায় থাকা পারুলের মা মরিয়মকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, পারুর টিউশনি করতে গেছেন। ছেলেরা বেঁচে নেই তাই টিউশনি করে কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়। ছোট ছেলে ইয়াসিন হিফজ মাদরাসায় পড়ে তার খরচ দিতে হয়। পারুল আরবি পড়ান। আর যারা আরবি পড়ায় তাদের তেমন টাকা দেয়া হয় না। ফলে পারুল বিবিকে সংসালের হাল ধরার জন্য অনেকগুলো টিউশনি পড়াতে হয়।
মরিয়ম বলেন, পারুলের স্বামী অন্য জায়গায় বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন অনেক আগেই। ফলে স্বামী ছাড়াই তিন ছেলেকে নিয়ে কোনরকম সংসার কেটে যাচ্ছিল পারুল বিবির। স্বপ্ন ছিল একদিন তার ছেলেরা বড় হয়ে লেখাপড়া করে চাকরি করবেন। ছেলেরাও তাকে স্বপ্ন দেখাতো তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না। একদিন তাদের গাড়ি বাড়ি সবকিছু হবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
পারুল বিবি বলেন, ‘আমার ছেলের অত্যন্ত ভালো ছিল। আমাকে কখনও মন খারাপ করতে দিত না। আমাকে সারাক্ষণ বিভিন্ন কথা দিয়ে স্বপ্নে বিভোর করে রাখতো। ছেলেদের কথা শুনলে আমার মন ভরে যেত। আজ আমার ছেলেরা নাই। আমাকে বলতো তুমি চিন্তা করো না। আমরা পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করে বাড়ি গাড়ি করবো। তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলেরা সবসময় নামাজ পড়তো কুরআন শরীফ পড়তো। ওইদিনও নামাজের আগে কুরআন শরীফ পড়েছিল। আজ আমার ছেলেরা নেই, কেউ নেই। ছোট ছেলেটিকে নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছি।’
এর আগে ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার পশ্চিমতল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আর এই ঘটনায় দগ্ধ অবস্থায় ৩৭ জনকে জাতীয় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে একে একে ৩৪ জনই মারা গেছেন।
এই অগ্নিকা-ের ঘটনায় যারা মারা গেছেন বর্তমানে তাদের প্রায় সকল স্বজনরাই কষ্টে রয়েছেন। কারও কারও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন তারা। তারপরেও বেঁচে থাকার তাগিদে নানাভাবে সংসারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেইসাথে মৃত্যুর চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও যেন তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদেরকে ভুলতে পারছেন না। এখনও যেন তাদের চোখের সামনে সবকিছু ভেসে উঠে।
এদিকে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৩৪ জন নিহতের ঘটনায় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুর গফুরসহ ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।
একই সাথে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও দায়ী করা হয় তিতাস, ডিপিডিসি ও মসজিদ কমিটিকে। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের হাতে ৪০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি। তদন্তে গ্যাস লাইনে লিকেজ, বিদ্যুতের সর্ট সার্কিট, মসজিদ কমিটির অবহেলা ও রাজউকের অব্যবস্থাপনাকে বিস্ফোরণের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
মামলার বর্তমান বিচার কার্যক্রম প্রসঙ্গে আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, মামলাটির বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বিচার কার্যক্রম শেষ হবে। সেইসাথে সকলেই ন্যায় বিচার পাবেন।
আপনার মতামত লিখুন :