নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা সদরের আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দেশের আর দশটা সরকারি হাসপাতালের মতোই ছিল এই হাসপাতালের পরিবেশ। ভেতরে-বাইরে নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, দালালদের উৎপাত। সেবার নিম্ন মান। এখন সেদিন বদলেছে। সর্বত্র লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। সেবার দিক থেকে প্রথম সারির সরকারি হাসপাতাল হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে।
সরেজমিন একদিন
গত ৮ ফেব্রুয়ারি সকালে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছিমছাম সবুজ চত্বর। চিরচেনা আবর্জনার স্তূপ নেই। ড্রেনগুলোও পরিস্কার। ময়লার ভাগাড় ছিল মূল ভবনঘেঁষে দুটি বড় জায়গায়। তা এখন ফল-ফুলের বাগান। ভবনের চারপাশেই এমন বাগান হয়েছে। মূল ফটক থেকে ভবনের সামনের চত্বর পর্যন্ত সারি সারি বাহারি রঙের বৈদ্যুতিক বাতি। পেছনের ডরমিটরির সামনের জায়গাগুলো বিভিন্ন ফলদ গাছের সমারোহ। হাসপাতালের ছাদে করা হয়েছে ছাদবাগান।
ভবনে ঢুকতেই দুটি টিকিট কাউন্টার। সামনে সেবাপ্রত্যাশী মানুষের ভিড়। দুই টিকিট বিক্রেতার দম ফেলার ফুরসত নেই। হেল্পডেস্কের সামনেও ভিড়। মাথার ওপর ঝুলছে ডিজিটাল সাইনবোর্ড। তা জানান দিচ্ছে বিভিন্ন সেবার বার্তা। প্রতিদিন শুরুতে দৈনন্দিন কার্যসূচি উপস্থাপন করা হয়। ইউএইচএফপিও ডা. সায়মা আফরোজ ইভা মনোযোগ দিয়ে তা শোনেন। আগের দিনের কাজের মূল্যায়ন শেষে দিনের কার্যক্রমের নির্দেশনা দেন। এরপর সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে বেরিয়ে পড়েন।
বদলের নেপথ্যে
একের পর এক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা যোগদান করলেও হাসপাতালটি সেবার মানের তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই পদে ডা. সায়মা আফরোজ ইভা যোগদান করেন। তারপর থেকে বদলে যেতে থাকে উপজেলার পাঁচ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবার এই প্রধান ভরসার জায়গাটি। ডা. সায়মা আফরোজ ইভা প্রথমে হাসপাতালের চিরচেনা সমস্যা শনাক্ত করেন। এরপর তা সমাধানে উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। হাসপাতালের চিত্র বদলে নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে ডা. সায়মা আফরোজ বলেন, মানুষের সেবা করাই আমার অনুপ্রেরণার উৎস। করোনা মহামারিকালীন আড়াইহাজার উপজেলা সব চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন। অধিকাংশ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হলেও আবার সুস্থ হয়ে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। ফলে করোনায় আড়াইহাজারে প্রায় সব আক্রান্ত রোগীই সুস্থ হয়েছেন। করোনাকালীন সময় থেকে মানবতার দেয়াল চালু করার মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অসহায়, দুস্থ ও কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সীমিত জনবল ও আসবাবপত্র সত্ত্বেও আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত করা হয়েছে। প্রসূতি মা ও শিশুদের জন্য ২৪ ঘণ্টা জরুরি চিকিৎসারসেবা চালু করা হয়েছে। জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা ডায়াবেটিস ও ইসিজি পরীক্ষা চালু এবং যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণে অটোক্লেভ মেশিন বসানো হয়েছে। নতুন এক্স-রে মেশিন আনা হয়েছে। প্যাথলজি বিভাগে বসানো হয়েছে ক্লোরমিটার, সেন্টিফিউজ মেশিন, মাইক্রোস্কোপ ও নেবুলাইজার। নরমাল ডেলিভারি বৃদ্ধির জন্য চিকিৎসক, মা ও শিশুদের পুরস্কারের মাধ্যমে মোটিভেশন করা হচ্ছে। গত জানুয়ারি মাসে ১০৮ জনকে নরমাল ডেলিভারি করা হয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে হাসপাতালের শ্বাসকষ্টজনিত রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য রেসপিরেটরি ইউনিট চালু করা হয়েছে। রেসপিরেটরি ইউনিট এ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে অভিজ্ঞ চিকিৎসক নার্সদের সমন্বয়ে শ্বাসকষ্ট রোগীদের আধুনিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর সেবার মান বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শিশুদের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিডস জোন চালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার মান বিবেচনায় বাংলাদেশে প্রথম সারিতে রয়েছে আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স; যা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের।
সেবায় সন্তুষ্টি
হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে কথা হয় কল্যান্দী সুবর্ণা ও পাঁচগাঁওয়ের মাহফুজের সঙ্গে। তারা জানান, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালেই করাতে পেরেছেন। ওষুধপথ্যও হাসপাতাল থেকে পেয়েছেন। কেবিনের মেঝে ও দেয়ালে টাইলস লাগানো। শৌচাগারও পরিচ্ছন্ন। সেবার প্রশংসা করলেন পার্শ্ববর্তী নরসিংদী মাধবদী থানার নুরালাপুর গ্রামের গোল আক্তার। তিনি জানান, চিকিৎসক ও নার্সরা নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে হাসপাতালের দুর্গন্ধমুক্ত পরিবেশ।
আড়াইহাজার উপজেলা সরকারি হাসপাতাল এখন প্রসূতি মায়েদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করেন স্থানীয় নারীরা। হাইজাদী গ্রাম থেকে মায়ের সঙ্গে এসেছেন ফারজানা নামে এক প্রসূতি নারী। ডা. শান্তা ত্রিবেদী তাকে চেকআপের পরামর্শ দিয়েছেন। সেবা পেয়ে ফারজানা বেশ সন্তোষ প্রকাশ করেন। অন্তর্বিভাগের ওয়ার্ডে প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি এখন। রোগীপ্রতি একজন দর্শনার্থী থাকতে পারেন। হাসপাতালে দালালদের দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। নেই ওষুধ কোম্পানির লোকজনের অবাধ উপস্থিতিও। গোটা হাসপাতাল এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে।
লোকবলের সংকট, তবু অনেক স্বপ্ন
৫০ শয্যার এই হাসপাতাল চলে ৩১ শয্যার লোকবলে। প্রতিদিন সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে বহির্বিভাগে ৫ শতাধিক রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। ২৮টি চিকিৎসকের পদের মধ্যে ১৩টি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। জরুরি বিভাগে আলাদা চিকিৎসকের পদ থাকার কথা থাকলেও এখানে একটিও নেই। তালিকা (রোস্টার) করে জরুরি বিভাগ পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ওয়ার্ডবয়, সুইপারসহ বেশ কয়েকটি পদে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। এরপরও মডেল হাসপাতালে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। এ জন্য দরকার নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ), কিডনির ডায়ালাইসিস সেবা, আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা যন্ত্র ইত্যাদি। সেগুলো চালুর আগেই নিশ্চিত করতে হবে দুটি বিষয় ৫০ শয্যার অনুকূলে জনবল এবং ২৫০ শয্যার নবনির্মিত ভবন চালু।
আপনার মতামত লিখুন :