নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের দোসরের ভূমিকা যখন আলোচনা সমালোচনা তখনই ভূমিদস্যুতা দাগ লেগেছে। আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পরেই ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ তুলেন নব্য দুই সংগঠনের সভাপতিরা। বিকেএমইএ’র সভাপতি জাতীয় পার্টির এমপি সেলিম ওসমান ও চেম্বারের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল ছাত্র-জনতার হতাহত মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। এতে সেলিম ওসমানের পরিকল্পনায় তাদের অনুগত দুই নেতাকে দায়িত্ব দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন বিএনপি নেতারা।
এদিকে বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি শোভন গ্রুপের মালিক আবু সিদ্দিকের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে অভিযোগ ফতুল্লার মাসদাইর পাকাপুলের জাহাঙ্গীর হোসেন, হিরু হক এবং শিউলী আক্তার গং। এর ফলে দোসরের পর ভূমিদূস্য নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে নারায়ণগঞ্জে।
ভূমিদূস্যতা নিয়ে অভিযোগে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক এমপি শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের পালিত সন্ত্রাসী মাদক বিক্রেতা স্বপনের নেতৃত্বে ইব্রাহিম হাজীর ছেলে রনি, সোহেল সহ আরও সন্ত্রাসী দিয়ে আমাদের সম্পত্তি দখলের পায়তারা করে। এতে তারা কয়েকজনকে ওই শিল্পপতি কারখানার ওয়েস্টেজ মালের লোভ দেখিয়ে বলেছে, আগে আমার জায়গা দখল করো এরপর ওয়েস্টেজ পাবে। গত ১৮ অক্টোবর রাতে আবু সিদ্দিকের নির্দেশনায় এক থেকে দেড়শ সন্ত্রাসীকে পাঠিয়ে জায়গা খালি করার হুশিয়ারি দেয়। তারা বলেন এ জায়গা বস আবু সিদ্দিকের। জায়গা না ছাড়লে অভিযোগকারীদের কিলিং করে হবে। এর আগে ১অক্টোবর জায়গার আলমগীর হোসেনকেও কয়েক দফা সন্ত্রাসী দিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়েছে। এ ঘটনায় আলমগীর হোসেন ফতুল্লা মডেল থানায় অভিযোগ করলেও পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধান দোসর গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াউদ্দিন। তিনি দাবী করেছেন, তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যবসা দিয়ে আমাদের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করছেন। এর আগে নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি মাসুদুজ্জামানকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন হয়েছিল। সেখানে অভিযোগ করা হয়েছিল বিগত দিনে মাসুদুজ্জামান আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের নবাগত সভাপতি মাসুদুজ্জামানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন চেম্বারের সদস্য কয়েকজন ব্যবসায়ীরা। তারা ও সময়ের বিদ্যমান পরিচালক পরিষদের আহবান করা বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বয়কটেরও ঘোষণা দেন। এ সময় সংবাদ সম্মেলনে গোলাম সারোয়ার সাঈদ বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন, তাদের বিরক্ত করা যাবে না। তবে যারা ব্যবসার নাম করে বিগত সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, দেশের সম্পদ লুটপাট করেছেন, বিগত সরকারের নেতাকর্মীদের অর্থপাচারে সহযোগিতা করছেন, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছেন, তাদেরকে কোনভাবেই ক্ষমা করা হবে না। আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায়ী সংগঠনে ফ্যাসিবাদের প্রেসক্রিপশনে যারা এতদিন দখল করে রেখেছিল তাদেরকে দায়িত্বে রাখা যাবে না। ব্যবসায়িক সংগঠনগুলিতে ব্যবসায়ীদের দ্বারা ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে নেতা তৈরি করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের উদারতার সুযোগ নিয়ে অতি চাতুর্যতার সাথে ফ্যাসিবাদের দোসর সোহেল গং (মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল) মাসুদুজ্জামানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কো-অপ্ট করেন। সেই সাথে ত্বকী হত্যাকাণ্ডের আত্মস্বীকৃত খুনি পরিবারের ব্যক্তিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদায়ন করেছেন। আমরা জানি না এ বিষয়ে ত্বকী মঞ্চ নিরব ভূমিকা পালন করছে কেন? খুনি পরিবারের সদস্যকে এত বড় একটি দায়িত্বে রেখে ন্যায় বিচার সম্ভব হবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকে যায়। ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে চাঁদা নেয়া নিয়ে বলেন, বিএনপি নিয়েছে বলিনি কিন্তু অভিযোগের তীর বিএনপির দিকে। ১৬ বছর বিএনপি-জামায়াত ব্যাকফুটে ছিল, এখন তারা ফ্রন্টলাইনে আছে। বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর এইটা তাদেরই ক্লিয়ার করতে হবে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের পতন ঘটলেও তাদের দোসরদের কব্জায় এখনো জিম্মি রয়েছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এমন বক্তব্য আসছে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে। দীর্ঘ ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রত্যেকটি টপ টু বটম আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট ছিল গত ৫ আগস্টের পর শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের পরিবর্তন ঘটলেও বর্তমানে যারা দায়িত্বে এসেছেন তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে ঘোর অভিযোগ। সম্প্রতি দুই শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অফ কমার্স এবং বিকেএমই নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। এর আগে পট পরিবর্তন ঘটা মাত্রই বিকেএমইএ ও চেম্বার থেকে চাঁদা নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন বর্তমান ব্যবসায়ী নেতারা। সেই চাঁদার টাকাও ফেরত দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় আওয়ামীলীগের সরকার আমলে কোন চাঁদাবাজি ঘটনা ঘটেনি। এ নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, টাকা ফেরত দেওয়ার ঘটনার সময়ে নাম প্রকাশ না করে বিএনপিকে কার্যত বিতর্কিত ও বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের সময়কালের কমিটিকে বিতর্কের বাইরে রেখেছেন।
চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সদস্য ব্যবসায়ী গোলাম সারওয়ার সাঈদ বলেন, বিগত দিনে মাসুদুজ্জামান আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন। স্বৈরাচারের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। যার পুরস্কার স্বরূপ শেখ হাসিনার সরকার তাকে সিটিজেন ব্যাংক উপহার দিয়েছিল। তিনি কত কোটি টাকা শেখ পরিবারকে দিয়েছেন এইটা নারায়ণগঞ্জবাসী জানতে চায়। স্বৈরাচার সরকারের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি গত ১৬ বছরে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন, এই বিষয়টি সরকারকে দেখতে হবে। সেইসাথে তাকে প্রমাণ করতে হবে কাকে তিনি চাঁদা দিয়েছেন এবং কে ফেরত দিয়ে গেছে। বিগত ১৬ বছরে তিনি কত টাকা চাঁদা দিয়েছেন সেটিও তাকে জনসমক্ষে বলতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও নতুন সরকার দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর নারায়ণগঞ্জ চেম্বার থেকে ৩ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ করেন সভাপতি মাসুদুজ্জামান। এছাড়া গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিকেএমএইএ থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা নেয়ার কথাও জানান। দায়িত্ব নেওয়ার পরেই মাসুদুজ্জামান বলেছিল চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে এবং চাঁদার টাকা ফেরত দিতে হবে। তা না হলে শহীদ মিনারে ওই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে লাল কার্ড প্রদর্শন করা হবে। এমন হুংকারে ১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এবং বিকেএমএইএ থেকে নেওয়া চাঁদার টাকা ফেরত আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তখন মোহাম্মদ হাতেম বলেন, চাঁদা নেয়া টাকা চেম্বারের নবনির্বাচিত সভাপতি ফেরত আনার ব্যবস্থা করেছে। তাকে সভাপতি হিসেবে বসিয়ে একজন যোগ্য লোককেই যে বসিয়েছি, সেটা কিন্তু প্রমাণ হলো। ওই সময়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা চাঁদাবাজদের নাম জানতে চাইলে তা জানাননি তারা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) টানা ১৪ বছর ১ মাস সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন সেলিম ওসমান। ২০১০ সালের ২২জুলাই প্রথমবারের মতো বিকেএমইএ সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই সময়ে সদর ও বন্দর আসনের এমপি বড় ভাই নাসিম ওসমান এবং ফতুল্লা আসনের এমপি চাচী কবরী সারোয়ার ছিলেন। সভাপতি থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে সদর ও বন্দর আসনে উপ-নির্বাচনে এমপি সেলিম ওসমান। এমপি ক্ষমতার সুবাধে বার বার সভাপতি হওয়ার জন্য বিকেএমএই নিয়মও পরিবর্তন করেছেন। গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকার পতন হয়। পরে ২৫ আগস্ট সংগঠনটির এক জরুরি বোর্ড সভায় ১৪ বছর যাবৎ সভাপতি সেলিম ওসমান ব্যক্তিগত কারণ ও অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে তার সভাপতি ও বোর্ড পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার স্থলে নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে সভাপতি দায়িত্ব দেন বোর্ড। তিনি এই সংগঠনের ১নং সদস্য এবং তিনি ডিসেম্বর ১৯৯৬ থেকে ২০০২ পর্যন্ত পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন মেয়াদে সহ-সভাপতি এবং সর্বশেষ দেড় মেয়াদে নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব ছিলেন। জরুরি বোর্ড সভায় ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম নির্বাহী সভাপতি এবং মাইক্রো ফাইবার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ শামসুজ্জামানকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তারা সকলেই বিদায়ী সভাপতি সেলিম ওসমানের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচয় রয়েছেন। নবগঠিত পরিচালচনা পর্ষদে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে রয়েছেন মনসুর আহমেদ। সহ সভাপতি হিসেবে আছেন অমল পোদ্দার, গাওহার সিরাজ জামিল, মোরশেদ সারোয়ার সোহেল সহ-সভাপতি (অর্থ), আখতার হোসেন অপূর্ব, মোহাম্মদ রাশেদ।
আপনার মতামত লিখুন :