২২ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনাটি সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান বলে জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। কিন্তু এখন আর সেভাবে মনে রাখা হচ্ছে না সেদিনে নিহতদের। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন তার একটি লেখায় বলেছেন, ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেদিনের ঘটনার পর সরকার ও মালিক পক্ষ শ্রমিকদের সাথে একটি মীমাংসায় পৌঁছে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল যা পোশাক শিল্পে নিট কারখানার শ্রমিকদের জন্য একটা বড় ধরনের নৈতিক বিজয়।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এর উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ জানান, ইতিহাসের পাতায় ৩ নভেম্বরের শ্রমিক আন্দোলন একটি অভ্যুত্থান।
জানা গেছে, ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীতে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০০ শিল্প কারখানা রয়েছে। এর বেশিরভাগই রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও ফতুল্লার শিবুমাকেট ও সিদ্ধিরগঞ্জে আদমজী ইপিজেডসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য গার্মেন্টসসহ শিল্প কারখানা। ২০০৩ সালের ১ নভেম্বর থেকেই বিসিকে প্যানটেক্স ড্রেস লিমিটেড নামের একটি রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ’ শ্রমিক বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন শুরু করে এবং সকাল থেকে কারখানার সামনে অবস্থান নিয়ে ধর্মঘট শুরু করে।
এর মধ্যে ৩ নভেম্বর এ কারখানার মালামালের শিপমেন্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে সেটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। ২ নভেম্বর রাতে সে সময়ের প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টরেট (এনডিসি) সৈয়দ বেলাল হোসেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঞ্জারুল মান্নান ও প্রকাশ কান্তির নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ প্যানটেক্স গার্মেন্টসের সামনে গিয়ে অবস্থান নেয়। পরে রাতে সেখানে ডেকে নেওয়ায় হয় শ্রমিক নেতা ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইলকে। রাতে ইসমাইল ও শ্রমিকদের সঙ্গে প্রশাসনের লোকজন বার বার বৈঠক করেও কোন সুরহা করতে পারেনি। বরং শ্রমিকেরা তাদের দাবির জন্য অটল থাকে।
৩ নভেম্বর ভোরে পুলিশ অ্যাডভোকেট ইসমাইলকে আটক করে ফতুল্লা থানায় নিয়ে যায়। ভোর ৬টার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ প্যানটেক্সের সামনে গিয়ে আন্দোলন করা শ্রমিকদের তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া ঢাকা থেকে ক্যাপ্টেন শহীদুল এর নেতৃত্বে সে সময়ের বিডিআর এর ছয় প্লাটুন সদস্য ফতুল্লায় আসে। বিডিআর ও পুলিশ একত্রে মিলে শ্রমিকদের অবরোধ সরানোর চেষ্টা করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে ফতুল্লার সকল প্রতিষ্ঠানে। রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ শ্রমিক। অন্যদিকে পুলিশও পাল্টা গুলি বর্ষণ করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। রণক্ষেত্র পরিণত হয় পুরো ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জ শহর। সকাল ৮টার দিকে হাজার হাজার শ্রমিক ফতুল্লা থানা ঘেরাও করে ইসমাইলকে ছাড়িয়ে আনে।
ঘটনার দিন পুলিশ শ্রমিকদের উপর নির্বিচারে গুলি ছুড়েছিল। অনেক শ্রমিকের হাত পা বেঁধেও চালানো হয়েছিল নির্যাতন। সংঘর্ষে প্যানটেক্স ড্রেস লিমিটেডের শ্রমিক আমজাদ হোসেন কামাল, সুমীসহ অন্তত অর্ধশত জন গুলিবিদ্ধসহ ৫ থেকে ৭’শ জন আহত হয়। গুলিবিদ্ধ আমজাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। সকাল থেকে রাত অবধি সংঘর্ষের পর পুলিশ কিছুটা পিছু হটে। কিন্তু পুলিশ সেদিন কৌশলে আমজাদের লাশ শ্রমিকদের না দিয়ে রাতের আধারে ফতুল্লার কাশীপুর কবরস্থানে দাফন করে।
সংঘর্ষে শহরের শতাধিক যানবাহন ভাংচুর করা হয়। শ্রমিকেরা বিভিন্ন কারখানায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় ১টি ও ফতুল্লা থানায় ১১টি মামলা হয়েছিল। পরিবহান মালিক, পুলিশ এসব মামলা করে।
অভ্যুত্থানের পরে ৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরে আধাবেলা হরতাল পালন করা হয়েছিল। হরতাল চলাচালে প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক সমাবেশ করে ঘটনার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন।
আপনার মতামত লিখুন :